পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির (১৯৯৭) দুই দশক পেরিয়ে বৃহত্তর পার্বত্যাঞ্চল যখন শান্তি, উন্নয়ন ও সম্প্রীতির পথে চলমান এবং পার্বত্য- উপজাতি ও পার্বত্য-বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সৌহার্দ্য দৃঢ়তর, তখন বান্দরবানের কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আলামত নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত সংলগ্ন অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও ভূরাজনীতিভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটির পাশেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজমান। এমতাবস্থায় নিরাপত্তা স্থাপনায় হামলা ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের হতাহতের ঘটনা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
ফলে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক তৎপরতাকে জাতীয় নিরাপত্তাগত নীতি ও কৌশলের আলোকে সরকারি, বেসরকারি, সামরিক, বেসামরিক ও সামাজিক শক্তির সমন্বয়ে প্রতিহত ও নির্মূল করা অপরিহার্য।
স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসে:
১. সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও বান্দরবানে বিচ্ছিন্নভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতার হেতু কি?
২. চাকরি, কোটা, উচ্চশিক্ষায় পাহাড়ের ১৩টি উপজাতির ব্যাপক উন্নয়ন-অগ্রগতি হলেও বান্দরবান অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় ও অতিক্ষুদ্র খুমী, খিয়াং, লুসাই, ম্রো, তঞ্চগ্যা, পাংখোয়া উপজাতিদের মধ্যে সশস্ত্র সন্ত্রাসী নাশকতারকারীদের অনুপ্রবেশ ঘটলো কেন ও কিভাবে?
৩. এইসব কতিপয় বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ মদদদাতা কে বা কারা?
৪. স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব এইসব বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দমনে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়ে প্রশাসন ও জনগণকে নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে কিনা?
৫. স্থানীয় এনজিও, সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা ও মিশনারি সমূহ শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার পক্ষে এবং সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিপক্ষে স্পষ্ট ভূমিকা পালন করেছি কি?
সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সবাইকে বিচলিত করছে, তা হলো, শান্তিচুক্তির পরেও পার্বত্যাঞ্চলে কিছু সন্ত্রাসী গ্রুপ ছিল বা আছে, যারা ছোটখাটো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু বান্দরবানের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কেবল চাঁদাবাজি বা আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করছে না। বরং তারা নিরাপত্তায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ ও স্থাপনায় হামলা করছে। এতে, এদের হীন মনোভাব ও অসৎ উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য চরম হানিকর।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বান্দরবানের রুমা বাজার থেকে লোঙ্গা খুমী নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে রুমা থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি সাংবাদিকতাকে সামনে রেখে দীর্ঘদিন যাবৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে কেএনএফকে নামক সংগঠনকে সাহায্য করে আসছিলেন। তিনি কেএনএফের পুর্বসংগঠন কেএনডিইউয়েরও সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আটক সাংবাদিক নামধারী ব্যক্তি সর্বদা কেএনএফের সোর্স হিসাবে কাজ করে আসছিলেন।
এসব তথ্য প্রমাণ করে যে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে নিরাপত্তার জন্য মারাত্মকভাবে বিপদজনক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের পক্ষে বহুজন বহু পেশা ও নামের ছদ্মাবরণে পার্বত্য সমাজে কাজ করছে। একই সাথে তারা নিরাপত্তার ঝুঁকি এবং সামাজিক, রাজনৈতিক বলয় তৈরি করছে।
এসব বিষয় স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় নেতাদের অজানা থাকার কথা নয়। তারা সচেতন থাকলে এদের বাড়বাড়ন্ত হতে পারতো না। ফলে নিরাপত্তাগত পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্র থেকেও সন্ত্রাসীদের এজেন্টদের চিহ্নিত ও মূলোৎপাটন করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামগ্রিকভাবে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের চলমান ধারায় বান্দরবানের সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুদূরপ্রসারী বিধায় সমস্যাটিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। বরং সামরিক, বেসামরিক ও সামাজিক শক্তিসমূহের সমন্বয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপের মাধ্যমে নাশকতাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে প্রতিহত ও নিমূল করে পাহাড়ে শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা অপরিহার্য।
শুধু বাংলাদেশ নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবিরোধী বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বান্দরবানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঠেকানো জরুরি। পাশাপাশি জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে বান্দরবানের সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যক্তি, সংগঠন ও সহযোগীদের অতিদ্রুত বিশেষ অভিযান এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে নিষ্ক্রয় করার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও অত্যাবশ্যক।