শাহজালাল তালুকদার ছিলেন বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর তিনি মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন। পথে তাঁকে ধাওয়া করে কয়েকজন সন্ত্রাসী। তিনি একপর্যায়ে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তাঁকে কুপিয়ে খুন করা হয়।
এই খুনের মামলার প্রধান আসামি করা হয় সাগর তালুকদারকে। তিনি পদে না থাকলেও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। অভিযোগ আছে, আশেকপুর ইউনিয়নে ‘সাগর বাহিনী’ নামে তাঁর একটি বাহিনীও আছে।
শাহজালালের ভাই নুরুজ্জামান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০২০ সালে সাগর বাহিনীর হাতে খুন হন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শিহাব উদ্দিন। শিহাব খুনের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তিনি (নুরুজ্জামান)। এ কারণে তাঁকে একবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। একই কারণে তাঁর ভাই শাহজালালকে খুন করা হয়।
বগুড়ায় ১১ দিন অবস্থান করে জেলা পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও জেলার রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ, দলটির সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের ৫৮ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এর মধ্যে দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হয়েছেন ৫১ জন। আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার প্রধান কারণ দলের পদ পাওয়া, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, দখল, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
৫১ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১০, যুবলীগের ২৫, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৯ ও ছাত্রলীগের ৭ জন। স্থানীয় রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মানুষেরা বলছেন, আধিপত্য বিস্তার এবং মাদক ও অন্যান্য ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে প্রবণতা বেশি যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। এ কারণে এই দুই সংগঠনের নেতা–কর্মী খুনের সংখ্যা বেশি।
বগুড়ায় এই ৫১টি খুনের মামলায় শুধু একটির বিচার শেষ হওয়ার কথা জানা গেছে। সেটি হলো বগুড়া শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক খায়রুল আনাম (রেক্কাত) হত্যা। এই ঘটনা ঘটেছিল ২০১২ সালে। মামলায় ১১ জন আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাই বলছেন, খুনের মামলার আসামিদের দলের পদ দেওয়া হয়। প্রশাসনও কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। কোনো কোনো মামলায় খুনের শিকার ব্যক্তির পরিবারকে সমঝোতা করতে বাধ্য করা হয়।
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বগুড়া-৫ আসনের (শেরপুর-ধুনট) সংসদ সদস্য মজিবর রহমান (মজনু) এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসানের কাছে কোন্দল ও খুনোখুনির বিষয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল। মজিবর রহমান বলেন, খুনোখুনি হচ্ছে, তবে দলের কোনো বিষয়ে নয়। খুনের ঘটনাগুলো ঘটছে নিজেদের স্বার্থে, ভাগ-বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে। যাঁরা জড়িত, তাঁরা সন্ত্রাসী।
খুনের শিকার ও মামলার মূল আসামিরা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের পদে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মজিবর রহমান বলেন, দু–একজনের পদ থাকতে পারে। সহযোগী সংগঠনের এসব পদের বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।
অন্যদিকে রাগেবুল আহসান দাবি করেন, আগে কিছু খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। এখন সেটা নেই বললেই চলে। খুনের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলে তিনি বলেন, এগুলো আওয়ামী লীগের মূল দলের নয়, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের। এগুলোর দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগের নয়।
অবশ্য বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নিয়ে ‘দলবাজি ও পেশিশক্তি’ বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।