গত প্রায় এক বছরে বিদেশি ঋণের ছাড় তেমন একটা বাড়েনি। খুব বেশি বাড়েনি নতুন বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতিও; কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বিদেশি ঋণ পরিশোধ প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এর ফলে প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণ শোধের পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। সার্বিকভাবে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ অনেকটাই বেড়েছে। সামনে এই চাপ আরও বাড়বে।
সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে বিদেশি ঋণের সুদাসল বাবদ ৩০৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণের সুদাসল বাবদ ২৪৬ কোটি ডলার পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার ৬০ কোটি ডলার বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে সুদ ও আসল মিলিয়ে বিদেশি দেনা শোধের মোট পরিমাণ ছিল ২৬৮ কোটি ডলার।
দেশের বৈদেশিক ঋণের হালনাগাদ পরিস্থিতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইআরডির তৈরি সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধ সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি প্রক্ষেপণ করছে। তাতে মন্ত্রণালয় মনে করছে, আগামী বছরগুলোতে ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে।
কয়েক বছর ধরেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের এই চাপ শুরু হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন দেশে লম্বা সময় ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ডলার-সংকটের এই সময় বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বাজেটে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধ পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল করতে হবে। বিশেষ করে মুদ্রা বিনিময় হার যেন বেড়ে না যায়, সে ব্যাপারে লক্ষ রাখতে হবে। আবার রপ্তানিও বাড়াতে হবে। চীন, রাশিয়ার সরবরাহকারী ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও যাচাই-বাছাই করতে হবে। সার্বিকভাবে বিদেশি মুদ্রার মজুত বাড়াতে হবে। গত দুই বছর যা চলেছে, এভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে বিদেশি ঋণ শোধ করার বিষয়টি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
বিদেশি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাস্তবতাও তুলে ধরেন আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা ফকির। আমাদের পছন্দ করার সুযোগ নেই। কারণ, আগামী দু-এক বছর রিজার্ভ ধরে রাখতে হবে। বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে চীন, রাশিয়া—যেখান থেকে পাওয়া যায়, ডলার আনতে হবে। এদিক থেকে আমরা অবশ্য উভয়সংকটে আছি।’
দেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানেন এমন কর্মকর্তারা মনে করছেন, মূলত চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া স্বল্প মেয়াদের ঋণের কারণে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এরই মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। মেট্রোরেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের কিস্তিও শুরু হয়েছে। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে অন্যান্য মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হলে চাপ আরও বাড়বে।
ইআরডি সূত্রে আরও জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধ বাবদ খরচ হয়েছে ১৮১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার এবং সুদ বাবদ ১২৫ কোটি ৩৬ ডলার। অর্থাৎ এই দুটি খাত বাবদ মোট প্রায় ৩০৭ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে ঋণের আসল পরিশোধের জন্য যেমন শতকোটি ডলারের বেশি খরচ করতে হয়েছে, তেমনই সুদের জন্যও বাংলাদেশকে বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলারের বেশি খরচ করতে হয়েছে।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে আসল পরিশোধ যে গতিতে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি গতিতে বেড়েছে সুদ বাবদ খরচ। গত জুলাই-মে সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বিদেশি ঋণের আসল পরিশোধ বেড়েছে ২৩ কোটি ডলার বা ৩৬ শতাংশ। কিন্তু সুদ বাবদ ব্যয় বেড়েছে ৪২ শতাংশ। আর্থিক মূল্যে প্রথম ১১ মাসে সুদের খরচ বেড়েছে ৩৭ কোটি ডলার।