চট্টগ্রাম নগরের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়নি। পরীক্ষামূলকভাবে গাড়ি চলাচল করছে। আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করে দেওয়ার আগেই গাড়ি চলাচলে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত নির্মিত এক্সপ্রেসওয়েটিতে। ঘটছে দুর্ঘটনা ও ছিনতাইয়ের ঘটনা।
সর্বশেষ গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ইপিজেড-সংলগ্ন এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহত দুই যুবকের নাম মোকতার (২৮) ও রুবেল (৩৬)। তাঁরা নগরের সদরঘাট থানার মাদারবাড়ী এলাকার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। তাঁরা পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকা থেকে মোটরসাইকেলে করে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে শহরে যাচ্ছিলেন।
‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বাঁক, চালকদের গতিসীমা না মানা, বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো, ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নিরাপদ যান চলাচলে ত্বরিত কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
তবে বাঁক নিয়ে সমস্যার কথা মানতে নারাজ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রকৌশলীরা। তাঁরা বলছেন, এগুলো স্বাভাবিক বাঁক। চলাচলে কোনো ঝুঁকি নেই। গতিসীমা না মেনে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে পুলিশকে চিঠি দেবেন।
চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত সাড়ে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে’-এর মূল অংশের উদ্বোধন হয়েছিল গত বছরের ১৪ নভেম্বর। তবে উদ্বোধন হলেও গাড়ি চলাচল শুরু হয়নি তখন। এরপর চলতি বছরের আগস্টের শেষ সপ্তাহে পরীক্ষামূলকভাবে গাড়ি চলাচল শুরু হয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় টোলের হার চূড়ান্ত করলে আনুষ্ঠানিকভাবে যান চলাচলের জন্য এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেওয়া হবে। এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।
পরীক্ষামূলক যান চলাচলের সময় সাময়িকভাবে ট্রাক, বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এক্সপ্রেসওয়েতে সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা হয় ৬০ কিলোমিটার। তবে আঁকাবাঁকা অংশে সর্বোচ্চ গতিসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ৪০ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি থামানো বা দাঁড় করিয়ে রাখা এবং গাড়ি থেকে নামা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, এসব নিষেধাজ্ঞার কিছুই মানা হয় না। এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে কাভার্ড ভ্যান, কনটেইনারবাহী গাড়ি ছাড়া প্রায় সব ধরনের গাড়ি চলাচল করছে। বাধা থাকলেও চলাচল করছে ট্রাক, মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচলরত গাড়ির অধিকাংশই হচ্ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল। এ ছাড়া চলাচলরত গাড়ির বড় একটা অংশ কার ও মাইক্রোবাস।
এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচলের সময় অধিকাংশ গাড়িই গতিসীমা মেনে চলছে না। বাঁকগুলোতেও গাড়ির গতি কমানোর প্রবণতা কম চালকদের। এক্সপ্রেসওয়ের দেওয়ানহাট, বারিক বিল্ডিং, সল্টগোলা, ইপিজেড, কাঠগড় এলাকায় বাঁক রয়েছে। বাঁকগুলোতে গতিরোধক রয়েছে, গতিসীমাও ৪০ কিলোমিটার। এরপরও গাড়ির গতি না কমিয়ে গাড়ি চালাতে দেখা গেছে চালকদের। এক্সপ্রেসওয়ের অনেক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রীরা বের হয়ে আসেন। ঝুঁকিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেও দেখা যায়।
নিষেধাজ্ঞা না মেনে গাড়ি চলাচলের বিষয়ে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে নিরাপদে গাড়ি চলাচলের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাঁকগুলোতে গতিরোধক বসানো হয়েছে। আলোকায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। একটু পরপর গতিসীমা, বাঁক, গতিরোধকের তথ্য জানিয়ে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চালক ও যাত্রীরা তা মানতে চান না। মোটরসাইকেল চলাচলে বাধা দিতে গেলে চালকেরা নিরাপত্তারক্ষীদের মারধর করেন, হেনস্তা করেন। একাধিকবার এ ঘটনা ঘটায় নিরাপত্তারক্ষীরা আর বাধা দেন না।
অতিরিক্ত গতি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেন মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, নির্ধারিত সীমার চেয়ে বেশি গতিতে গাড়ি চালালে স্বাভাবিকভাবে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এক্সপ্রেসওয়েতে গতি রোধ এবং গতির সীমা ভঙ্গ করতে স্পিড মেশিন বা ক্যামেরা বসানোর জন্য পুলিশকে চিঠি দেওয়া হবে। নিয়ম ভঙ্গ করলে পুলিশই ব্যবস্থা নিতে পারবে। নিয়ম মেনে গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা কম। আর বাঁকগুলোর নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে চালকদের গাড়ি চালাতে কোনো সমস্যা না হয়।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারকারী গাড়িচালক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক্সপ্রেসওয়েতে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। কখনো পেছন থেকে এসে সামনের গাড়িকে ধাক্কা দেয়। কখনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি পড়ে যায়।
তবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে রাতে সুতা বেঁধে ছিনতাইয়ের ঘটনা। দেড় মাস ধরে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা কিংবা অভিযোগ না করায় তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। ছবি তোলা কিংবা দল বেঁধে ঘোরার ভান করে এরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অবস্থান নেয়। যখন গাড়ি চলাচল কম থাকে, তখনই মোটরসাইকেল আরোহীদের নিশানা করে তারা। যারা ছিনতাইয়ে জড়িত, তাদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত এবং উঠতি বয়সের ছিনতাইকারী।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি ও সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চলাচলে সতর্কতা হিসেবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়ের অনেক জায়গায় সাপের মতো আঁকাবাঁকা রয়েছে। এই বাঁকগুলো প্রকৌশলগতভাবে ঠিকভাবে করা হয়নি। বাঁকের কারণে ঘন ঘন গতিরোধক দিতে হয়েছে। এতে অনেক সময় চালকের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি থাকে এবং দুর্ঘটনা ঘটবে। দুর্ঘটনা রোধে বাঁকগুলোতে গতি কমানো উচিত। আর দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে অবশ্য ছোট যানবাহন বিশেষ করে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করতে হবে। কর্তৃপক্ষ এসব ব্যবস্থা নেবে, তবে গাড়িচালকেরাও যাতে দুর্ঘটনা রোধে নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে গাড়ি চালান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।