আমরা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন, মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি। কারণ দেশের মানুষের শান্তি, নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ও মহান বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী পর্বে সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয় যৌথভাবে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রধান অতিথি এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সম্মানিত অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন।
জাতির পিতার ছোট মেয়ে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলার মুক্তির সংগ্রামে সার্বিক সহায়তার জন্য ভারতের অবদানের কথা পুনরায় স্মরণ করে শেখ হাসিনা সুবর্ণ জয়ন্তীর এই উদযাপনে অংশগ্রহণের জন্য ভারতের রাষ্ট্রপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সম্মানিত অতিথি হিসেবে এই গৌরবগাঁথার দিনে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন। আমি তাঁর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’
ভারতীয় রাষ্ট্রপতি অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে স্বাগত জানান।
শুভেচ্ছা বক্তৃতা করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ক ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী স্বাগত বক্তৃতা করেন।
করোনার কারণে এর আগে না পারলেও আজ বিজয়ের উৎসব ব্যাপকভাবে দেশব্যাপী উদযাপিত হওয়ায় শেখ হাসিনা দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এবার আমরা নতুন উদ্যমে আমাদের বিজয়ের উৎসব করেছি এবং এই উৎসব শুধুমাত্র উৎসব নয়, এ উৎসব আমাদের আগামী দিনে চলার পথের প্রতিজ্ঞা। বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে ইনশা আল্লাহ আমরা গড়ে তুলব।’
জাতির পিতার রেখে যাওয়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ করাই তাঁর লক্ষ্য এবং আজকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হলো। এ সময়ে আমরা কতটুকু এগুতে পেরেছি সেটাই বড় কথা।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘দারিদ্র্যের হার ৪০ ভাগ থেকে ২০ ভাগে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি দেশের প্রতিটি গৃহহীনকে ঘর করে দেওয়ার কর্মসূচি সরকার অব্যাহত রেখেছে।’
জাতির পিতার যে স্বপ্ন, দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর, তা তাঁর সরকার পূরণ করতে পারবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস তাঁর সরকারের এগিয়ে যাওয়ার পথে অনকেটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও এই কোভিড-১৯কে নিয়ন্ত্রণ করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে তাঁর সরকার সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ জাতির পিতার পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ অনুসরণ করেই সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। এ দেশে সব ধর্মের মানুষ সমানভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে এবং তারা সেটা পালন করছে, সেটা আমরা নিশ্চিত করেছি।’
শেখ হাসিনা জানান, ২০২১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য ছিল, তাঁর সরকার উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভের মধ্য দিয়ে সেটা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এখন লক্ষ্য ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলা।
অনুষ্ঠানে উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে ‘মুজিব চিরন্তন’ বিশেষ শ্রদ্ধাস্মারক প্রদান করেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত দুটি স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। এ দুটি স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
’৭৫ এর বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করে সে সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী জানান, তিনি এবং তাঁর সঙ্গে বেঁচে যাওয়া পরিবারের একমাত্র সদস্য ছোট বোন শেখ রেহানাকে বিদেশে রিফ্যুজি জীবন যাপন করতে হয়েছে, দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। সে সময় দেশে একে একে ১৯টি ক্যু হয়, ক্যুর অজুহাতে সশ্রস্ত্র বাহিনীর অনেক সদস্যকে হত্যা করা হয়।
’৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এক রকম জোর করে দেশে ফিরে আসার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী জানান, এরপর থেকেই তিনি জাতির পিতার আদর্শে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এলেও ২০০১ সালে আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি। তবে, ২০০৮ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর আজকে পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ দেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়, তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে, সেই লক্ষ্য নিয়েই বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন, নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে গেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতির পিতা আমাদের একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র উপহার দিয়ে গেছেন।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনতে বঙ্গবন্ধুর নিজের জীবনকে বারবার ঝুঁকিতে ফেলার ইতিহাস তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে হানাদার বাহিনীরা তাঁকে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে বন্দী রাখে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে ফাঁসি দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাঙালিরা গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করলে বঙ্গবন্ধুকে তারা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এদেশের মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু বারবার তাঁর জীবনকে বাজী রেখেছিলেন। একটা জাতির মুক্তির জন্য একজন নেতা (বঙ্গবন্ধু) কীভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারেন, এটা একটা দৃষ্টান্ত।’
১৬ ডিসেম্বর হানাদারবাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও তাঁদের বন্দিদশায় আটকে থাকতে হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তখনও আমার মা, বোন শেখ রেহানা, ছোট ভাই রাসেল, আমার শিশুপুত্র জয় (সজীব ওয়াজেদ জয়) পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলাম। পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর ভারতের সামরিক অফিসার অশোক তারা এসে আমাদের মুক্ত করেন। আমার ছেলে জয়ের জন্মই হয়েছে বন্দিদশায় থাকতে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলছিলেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত হিসেবে দেশকে যখন তিনি গড়ে তুলছিলেন, ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়ে সহযোগিতা করেছে। মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেশ কিছু সংখ্যক ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য শহীদ হয়েছেন। আজ তাঁদের গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি, সশস্ত্র বাহিনীর শহীদ সদস্যদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।’
ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে তার স্ত্রী এবং মেয়েও অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় তাঁদের স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ২০২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেছিলাম। কিন্তু করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠান ২০২১ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের সঙ্গে পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করি। এর মধ্যেই আমরা চলতি বছর মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ সার্কভুক্ত পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা অনুষ্ঠানমালায় যোগ দিয়েছিলেন। বিশ্ব নেতারা অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাণী প্রেরণ করেছেন। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’