‘শয়তানের নিশ্বাস’ এখন চট্টগ্রামের প্রতারক চক্রের হাতে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 28-05-2024
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

ছিনতাই ও প্রতারণায় এবার চট্টগ্রামের অপরাধীরাও শয়তানের নিশ্বাস নামে পরিচিত স্কোপোলামিন নামের রাসায়নিক ব্যবহার করছে বলে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ধুতরার ফুল এবং আরও কিছু রাসায়নিকের মিশ্রণে তৈরি স্কোপোলামিন মেক্সিকো থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। এই ভয়ংকর রাসায়নিক প্রয়োগে মুহূর্তে কোনো ব্যক্তির স্নায়ুর কার্যকলাপ, মস্তিষ্কের ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক প্রভাব পড়ে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে তখন ওই ব্যক্তি অন্যের কথায় কাজ করেন। সার্বিকভাবে ব্যক্তির চিন্তা-বুদ্ধি লোপ পায়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনো অস্ত্র ছাড়াই ওই ব্যক্তির সবকিছু নিয়ে নেয় ছিনতাইকারী ও প্রতারক চক্র।

গত বুধবার মো. জনি নামের অপরাধী চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর স্কোপোলামিন ব্যবহারের তথ্য পায় পুলিশ। ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের পাটোয়ারী গতকাল সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ দেখতে পায়, ফাতেমা বেগম নামের এক নারী অপরাধী চক্রটির সদস্যদের পেছনে হেঁটে যাচ্ছেন। আর তাঁদের কথামতো নিজের কানের দুল, গলার চেইন খুলে দিচ্ছেন, যার মূল্য ৮০ হাজার টাকা। স্বর্ণালংকার ছাড়াও নিজের কাছে থাকা এক হাজার টাকা, মুঠোফোন ও বাজারের ব্যাগ দিয়ে দেন। দেখে মনে হচ্ছে, অপরাধীরা তাঁর পূর্বপরিচিত। পুলিশ বুঝতে পারে, ফাতেমার নাকের কাছে স্কোপোলামিন বা বুদ্ধিনাশক ওই রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়েছে। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে চক্রের এক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

জানা গেছে, স্কোপোলামিন মূলত একটি কৃত্রিম রাসায়নিক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। বমি বমি ভাব, মোশন সিকনেস এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন–পরবর্তী জটিলতা কাটাতে এর ব্যবহার আছে। তবে এটি প্রাকৃতিক কোনো উপাদান নয়, বরং প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে কৃত্রিমভাবে স্কোপোলামিন তৈরি করা হয়। এটা তরল ও পাউডার—দুই রূপেই পাওয়া যায়। তবে এর গুরুত্বপূর্ণ বা মূল উপাদান আসে ধুতরা ফল থেকে। মেক্সিকোর মাদক চক্রই এই মাদক বানিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে বলে সম্প্রতি বিবিসির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক পিংকু পোদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, স্কোপোলামিন মানুষের নাকের চার থেকে ছয় ইঞ্চি কাছাকাছি এলেই নিশ্বাসের আওতায় আসে। মেমোরি আর ব্রেন তখন সচেতনভাবে কাজ করতে পারে না। কারও ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতে এক ঘণ্টা লাগে। আবার কেউ তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যেও স্বাভাবিক হতে পারেন না।

ফাতেমার সঙ্গে যা ঘটেছিল

ডবলমুরিং থানার ওসি ফজলুল কাদের পাটোয়ারী প্রথম আলোকে জানান, ২২ মে ফাতেমা বেগম নগরের ডবলমুরিং থানার ব্যাপারীপাড়া মোড়ে সবজি কিনতে যান। কিনে বাসায় ফেরার পথে দুই ব্যক্তি এসে তাঁকে বলেন, ‘খালা, আপনার বাসার আশপাশে কোনো গরিব লোক বা ফ্যামিলি আছে কি না, থাকলে আমরা টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করব। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য। আমরা আপনাকে টাকা দিচ্ছি। আপনি আপনার এলাকার গরিব লোকদের দিয়ে দেবেন।’

ফাতেমা সামনে এগোতেই চক্রের দুজনের মধ্যে একজন তাঁর পেছন দিক থেকে হাতে থাকা লেবু দিয়ে ফাতেমার পিঠ স্পর্শ করেন। লেবুর স্পর্শে ফাতেমা পেছনে ফিরে তাকাতেই অপর ব্যক্তি তাঁর হাতে থাকা একটি লেবু ফাতেমার নাকের সামনে এনে ফুঁ দেন। ফুঁ নাকে লাগতেই ফাতেমা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। বুদ্ধিশূন্য হয়ে যান, নিজে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। তখন চক্রের আরেক সদস্য এসে বলেন, ‘আন্টি, আপনার কানে দুল, গলায় চেইন আছে, আপনি ওগুলো খুলে আমাদের দেন।’ বুদ্ধিশক্তি হারানো ফাতেমা তাঁর গলার চেইন, কানের দুল খুলে দিতে থাকেন তাঁদের।

ওসি ফজলুল কাদের পাটোয়ারী আরও বলেন, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, পথচারী আর চারপাশে থাকা অনেক লোক দেখেছেন, কীভাবে ফাতেমা তাঁর কানের দুল, গলার চেইন খুলে দিচ্ছেন। লোকজন মনে করেছেন, তাঁরা হয়তো আপনজন, হয়তো জরুরি প্রয়োজন পড়ায় কানের দুল, গলার চেইন খুলে দিচ্ছেন। পথচারী, স্থানীয় লোকজন বুঝতেই পারেননি যে বুদ্ধিনাশক কিছু দিয়ে বুদ্ধিশূন্য করে কানের দুল, গলার চেইন খুলে নিয়ে যাচ্ছেন দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিরা। বুদ্ধিশূন্য ফাতেমা তাঁর হাতে থাকা তরকারিও তুলে দেন এই অপরাধীদের কাছে।

কেন ফাতেমা তাঁর সবকিছু চক্রটির হাতে তুলে দিলেন, প্রশ্নের উত্তরে ডবলমুরিং থানার ওসি ফজলুল কাদের পাটোয়ারী জানান, ফাতেমার নাকের কাছে স্কোপোলামিন ছড়িয়ে দিয়ে ফাতেমার চিন্তাশক্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন অপরাধীরা। স্কোপোলামিনের প্রয়োগে চিন্তা-বুদ্ধিশক্তি হারিয়ে অপরাধীরা যা করতে বলেছেন, তা–ই করেছেন ফাতেমা। ঘটনার কিছুক্ষণ পর ফাতেমা তাঁর বুদ্ধিশক্তি ফিরে পেয়ে সন্তান-স্বামীসহ থানায় এসে জানান ঘটনাটি। এরপর পুলিশ সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে বিষয়টি নিশ্চিত হয়। চক্রের গ্রেপ্তার এক সদস্যও ঘটনাটি স্বীকার করেছেন।

চক্রটি কত দিন ধরে চট্টগ্রামে এ কাজ করছে, জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল কাদের পাটোয়ারী বলেন, ‘তারা আগে ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করত। এখন নতুন এই কৌশলে অপরাধে নেমেছে। পুরো চক্রটিকে গ্রেপ্তার করা গেলে বিস্তারিত জানা যাবে। চক্রের সদস্যদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।’

ভুক্তভোগী ফাতেমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন আমি তাদের হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিলাম। তারা যা বলেছে, তা–ই করেছি। পরে বাসায় আসার পর আমি বিষয়টি বুঝতে পারি। স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে আলাপ করে থানায় মামলা করি। আমার মতো আর কেউ যাতে এই প্রতারণার শিকার না হন।’

নগরবাসীকে শয়তানের নিশ্বাস থেকে সচেতন থাকার পরামর্শ পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল কাদের পাটোয়ারীর। ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে নগরবাসীকে সতর্ক করতে নিজের ফেসবুকে পোস্ট দেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অপরিচিত কেউ কোনো কাগজ কিংবা জিনিসপত্র দিলে তা নাকের কাছে নেওয়া যাবে না।

শেয়ার করুন