“পার্বত্য শান্তি চুক্তি”র ২৬ বছরেও পাহাড়ে অঁধরা শান্তি নামের সোনার হরিণ। এখনো থামেনী অস্ত্রবাজী,অপহরণ,চাঁদাবাজী। পাহাড়ে এক দিকে বাঙালিরা এখনো যেমনি চাঁদার কষাঁঘাতে জর্জরিত। তেমনি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবীতে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে ক্ষুব্দ।
ফলে পাহাড়ে খোলা চোখে দেখতে যেমন শান্তি বিরাজের বুলি নানা প্রতিষ্ঠানের মূখে আওরালেও অন্তরালে ভয়-ভীতি আর চাঁদার জ¦ালে আবদ্ধ। ফলে স্বাধীন এদেশে থেকেও নিজ দেশে পরবাসী বাঙালিরা। এছাড়াও গুচ্ছগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরা এখন তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতন জীবন যাপন করলেও তাদের ৮৪ কেজি চাল-গমে আবদ্ধ রেখে তাদের মরণ ফাঁদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ গুচ্ছগ্রামবাসীদের।
পরিবার পরিজন সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও তাদের তেমন কোন সুযোগ সুবিধা থাক দুরের কথা খোঁজ নেওয়ারও মানুষ নেই পাহাড়ে। বাঙালি সংগঠনগুলো নিদিষ্ট ইস্যুতে মাঠে সক্রিয় থাকলেও বাঙালিদের পক্ষে তাদের দাবী আদায়ে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেই পার্বত্য চট্টগ্রামে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর পাহাড়ি-বাঙালি সম অধিকার বা জনসংখ্যা অনুপাতে সুযোগ সুবিধা প্রদানের কথা বলা হলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালিরা বৈষমের স্বীকার হচ্ছে বলে বার বার বক্তব্যে উঠে আসছে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যে। তারপরও সে সব বিষয়ে কর্ণপাত নেই কারো।
এদিকে পাহাড়ে প্রকাশ্যে আর গোপনে অস্ত্রবাজী,অস্ত্রের মজুদ বাড়লেও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে তেমন কোন তৎপরতা নেই। ফলে দিনে দিনে পাহাড়ের নিরাপত্তা শঙ্কা বাড়ছে। আগে এক গ্রুপের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করলেও বর্তমানের ৬টির অধিক আঞ্চলিক সংগঠন সক্রিয় হয়ে উঠেছে পাহাড়ে। তাদের আধিপত্যের লড়াই,অস্ত্রের ঝনঝনানিতে আতঙ্ক বাড়ছে। এখনো থামেনী অপহরণের মত ঘটনা। ফলে পাহাড়ে এখনো অঁধরা শান্তি নামের সোনার হরিণ।
আঞ্চলিক দলগুলো নিজেদের মাঝে যেমন দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়াচ্ছে তেমনি অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি, ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের ফলে পাহাড়ি জনপদ এখনও রক্তাক্ত হচ্ছে। ফলে পাহাড়ে যারা বসবাস করছেন তাদের অধিকাংশের মনে শান্তি নেই। প্রতিনিয়ত পাহাড়ের মানুষ পাহাড়ি বাঙালি সবাই আতঙ্ক উৎকণ্ঠা কাটছে না। পাহাড়ে যেন এখনো বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজমান।
পার্বত্যাঞ্চলের অনেকেই মনে করেন সন্তু লারমা গ্রুপ শান্তি চুক্তির পর রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিলেও পাহাড়ে শান্তি রক্ষার বদলে পর্দার আড়াল থেকে অশান্তি সৃষ্টিতে তৎপর। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকার তৎপর হলেও দেশের কিছু ব্যক্তি ও কিছু বিদেশি এনজিও অর্থ খরচ করে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে।
রাতে চিৎকার শুনলেই অজানা আতঙ্কে আঁতকে উঠেন পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালিরা। চাঁদা না দেয়ায় হয়তো পুড়ে গেল কোনো পরিবারের কপাল। দেশের ৬১ জেলায় সাধারণ মানুষ তার ঘরে ঘুমালেও পাহাড়ে বসবাসকারীরা বাঙালিদের ব্যবসার ক্ষেত্রে পাহাড়ের চিত্রটা ভিন্ন।
মুলত সন্তু লারমার বাহিনীর সঙ্গে সরকারের শান্তি চুক্তি হলেও শান্তি নেই পার্বত্য তিন জেলার মানুষের মনে। দিন যতই যাচ্ছে ততই যেন অশান্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। পর্যটনে বিপুল সম্ভাবনার পাহাড়ে গড়ে উঠছে অবৈধ অস্ত্রের ভান্ডার আর সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। অরিক্ষত সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে অবাধে ঢুকছে অবৈধ এসব অস্ত্র।
সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মূল অভিযোগে পাহাড়ের কােন সংগঠন তাদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এ তালিকায় রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জেএসএস সংস্কার ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ),ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক,মগ লিবারেশন পার্টি, কেএনএফসহ ৬ এর অধিক পার্টি।
অন্যদিকে ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ শান্তি প্রতিষ্ঠার এক বিরল দৃষ্টান্ত বলে আখ্যায়িত করে পাহাড়ে চুক্তির বর্ষপূর্তি এলে ঘটা করে পালন হয় পার্বত্য তিন জেলা খাগড়াছড়ি,রাঙামাটি,বান্দবানে। চুক্তি সম্পাদককারী পক্ষের দাবী দীর্ঘ সময় ধরে এই সঙ্কটটি কখনই রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কখনও দমন নিপীড়ন এবং কখনও অগণতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের বিধিবিধান ও আইন অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী চুক্তি।
দীর্ঘ সময় ধরে এই সঙ্কটটি কখনই রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কখনও দমন নিপীড়ন এবং কখনও অগণতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সুদীর্ঘকাল বিরাজমান সঙ্কট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬ সালে প্রথম বারের মতো পার্বত্য জেলায় দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন।
তারই ধারাবাহিকতায় পাহাড়ি-বাঙালি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখার স্বার্থে শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে আরও অনেক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে জনসংহতি সমিতির প্রায় দুই হাজার সদস্য অস্ত্র সমর্পণ করে। সরকার তাদের পুনর্বাসন করাসহ পুলিশ ও আনসারে ৬৮৫ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন পদে তাদের নিয়োগ দেয়।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই পর্যায়ক্রমে চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে। পাশাপাশি চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার বিগত ২৬ বছরে শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে অধিকাংশ উল্লেখযোগ্য ধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। চুক্তির অবশিষ্ট বেশ কিছু ধারা বর্তমানে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন।
বর্তমান সরকার আন্তরিকভাবে বাকি ধারাগুলো বাস্তবায়নের কাজ করে যাচ্ছে। অনেকের মতে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক অগ্রগতি হয়নি। একটি কুচক্রি মহল পাহাড়কে অশান্ত করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল রাখতে নানা উস্কানি দিয়ে চলেছে। সম্প্রতি খাগড়াছড়ি জেলা থেকে এই মহলটি শফিকুল ইসলাম রাসেল নামে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করেন।
এছাড়াও প্রতিনিয়তই চলছে গুম, খুন, অপহরণ হত্যার মতো জঘন্ন কাজ। পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর গত ২৬ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির যে উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে সেগুলো হল: ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ভূমি কমিশন কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার ভূমি সমস্যা সমাধানের কাজ চলছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। ‘ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা’ প্রণীত হলে ভূমি কমিশনে জমা পড়া বিরোধসংক্রান্ত আবেদনগুলোর শুনানি শুরু হবে। শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা এবং পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল-২০১০ জাতীয় সংসদে গৃহীত
হয়েছে।
তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। ১৯৭৬ সালে জারি করা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অধ্যাদেশ বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০১৪ জাতীয় সংসদে পাস
করা হয়েছে। চাকরির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নির্ধারিত কোটা অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মাননীয় সংসদ সদস্যকে প্রতিমন্ত্রী সমমর্যাদায় নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।
১৯৯৮ সালে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হয়েছে। শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলের জেলাগুলোয় স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের আওতা বৃদ্ধি এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়েছে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি,সেটি সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে রক্তক্ষয়ী সংঘাতময় পরিস্থিতি যুগের পর যুগ বিরাজমান ছিল। সমস্ত উদ্বেগ, শঙ্কা, উৎকণ্ঠা এবং রক্তক্ষয়ী সেই সংঘাতময় পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘটে ১৯৯৭ সালের ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। এই ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে সবাই যৌথভাবে একযোগে কাজ করতে পারলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পথ সুগম হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের নাম বিশ্ব ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।