জমিসংক্রান্ত বিরোধ–মীমাংসার কথা বলে নিজেই দখল করে নিতেন সেই জমি। এ যেন ‘বানরের রুটি ভাগাভাগি’র পুরোনো সেই গল্প। অন্যরা জমি বেচাকেনা করতে গেলেও তাঁকে কমিশন দিতে হতো। সরকারি প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণেও ছিল তাঁর হস্তক্ষেপ। বালুমহাল, জলাশয় ও উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গত ১৬ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে কয়েক গুণ।
শুধু কি জমিজমা! আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীসহ নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও তাঁর নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন, বানিয়েছেন স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি।
নিজের অনুসারীদের নিয়ে গোটা জেলায় দখলদারি কায়েম করার এমন অভিযোগ হবিগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবু জাহিরের বিরুদ্ধে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আবু জাহিরের ক্ষমতার দাপট শুরু হয় বলে অভিযোগ করেছেন দলের নেতা-কর্মীরা। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবু জাহির তখন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। পদ পেয়েই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান। ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে হবিগঞ্জ-৩ আসনে কিবরিয়ার পাশাপাশি আবু জাহিরও দলীয় মনোনয়ন চান। তবে দল কিবরিয়াকে মনোনয়ন দেয়।
২০০৫ সালে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন শাহ এ এম এস কিবরিয়া। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে জয়ী হন আবু জাহির। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনেও তিনি হবিগঞ্জ-৩ (হবিগঞ্জ সদর, লাখাই ও শায়েস্তাগঞ্জ) আসন থেকে সংসদ সদস্য হন।
শুধু কি জমিজমা! আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীসহ নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও তাঁর নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন, বানিয়েছেন স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি।
হবিগঞ্জ শহরের টাউন হল সড়ক (হাইস্কুলের পাশে) এলাকায় সাড়ে ৮ শতক জমির ওপর পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে আবু জাহিরের। এলাকার মানুষের মধ্যে প্রচার আছে, আশির দশকে স্থানীয় এক হিন্দু পরিবারের পুকুর ভরাট ও জমি বিক্রি করে দেওয়ার বিনিময়ে ওই জমিটুকু পান আবু জাহির।
বাড়িটির পাশেই ৪ শতক জমির ওপর মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী ফরিদ মিয়া, খোয়াজ মিয়া ও নিজাম উদ্দিন নামের তিন ভাইয়ের তিনতলা বাড়ি। ভাইদের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে আবু জাহির সম্প্রতি বাড়িটি নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। খোয়াজ মিয়া ও নিজাম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ফরিদ মিয়ার স্ত্রীকে দিয়ে তাঁদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করেন আবু জাহির। এরপর একদিন তাঁদের দুই ভাইকে ডেকে নিয়ে জাহির বলেন, বাড়ির ফরিদ মিয়ার অংশ তিনি কিনেছেন। একপর্যায়ে চাপের মুখে ৪ কোটি টাকার বাড়িটি ১ কোটি ২৬ লাখ টাকায় গত মার্চ মাসে দলিল করে দিতে বাধ্য হন তাঁরা। প্রতিশ্রুত ১ কোটি টাকা দিলেও বাকি ২৬ লাখ টাকা পরিশোধ করেননি আবু জাহির।
সদর উপজেলার জালালাবাদ-নোয়াগাঁও গ্রামে প্রায় ৩০০ একর পতিত জমি নিয়ে দুই দল গ্রামবাসীর মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। আবু জাহির এ বিরোধ মীমাংসা করে দেওয়ার কথা বলে ১০১ একর জায়গা নিজের দখলে নেন। ২০১১ সালে এ জায়গার ওপর নিজের ও স্ত্রীর নামে আলেয়া-জাহির কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
নোয়াগাঁও গ্রামের হাবিবুর রহমান ও ইউসুফ আলী বলেন, আবু জাহির গ্রামে একটি চক্র তৈরি করে গ্রামবাসীর পতিত জমি দখল করান। এ নিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে দখলদারদের বিরোধ দেখা দেয়। আবু জাহির বিরোধ–মীমাংসার কথা বলে ১০১ একর জমি কলেজের নামে লিখে নেন।
বাড়িটির পাশেই ৪ শতক জমির ওপর মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী ফরিদ মিয়া, খোয়াজ মিয়া ও নিজাম উদ্দিন নামের তিন ভাইয়ের তিনতলা বাড়ি। ভাইদের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে আবু জাহির সম্প্রতি বাড়িটি নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সদর উপজেলার ওলিপুর ও এর আশপাশে গত ১০-১২ বছরে প্রায় অর্ধশত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সুবিধা থাকায় দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পগোষ্ঠী এখানে তাদের কারখানা গড়ে তুলেছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা ওলিপুরে জমি কিনতে পারলেও সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাহিরের ‘ছাড়পত্র’ ছাড়া নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) করতে পারতেন না। জমির দামের ১০ শতাংশ কমিশন দিলেই কেবল নিবন্ধন হতো বলে অভিযোগ রয়েছে।
একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বড় কারখানা রয়েছে ওলিপুর এলাকায়। প্রতিষ্ঠানটির জমি কেনার সময় আবু জাহিরকে পাঁচ কোটি টাকা কমিশন দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জমি কেনার পর প্রায় এক বছর আমরা এর রেজিস্ট্রি করতে পারিনি। আবু জাহির সাবরেজিস্ট্রারকে বলে দিয়েছেন আমরা যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তাঁর সঙ্গে দেখা করার অর্থ তাঁর চাহিদা পূরণ করা।’
সদর উপজেলায় সাবরেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিনিয়ত আবু জাহিরের লোকজন সাবরেজিস্ট্রার অফিস নজরদারিতে রাখতেন। কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের লোকজন জমি নিবন্ধন করতে এলেই খবর পৌঁছে যেত আবু জাহিরের কাছে।
জমি কেনার পর প্রায় এক বছর আমরা এর রেজিস্ট্রি করতে পারিনি। আবু জাহির সাবরেজিস্ট্রারকে বলে দিয়েছেন আমরা যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তাঁর সঙ্গে দেখা করার অর্থ তাঁর চাহিদা পূরণ করা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরিচালক
হবিগঞ্জে সড়ক ও জনপথ বিভাগ গত ১৬ বছরে যত বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছে, তার সব কাজেই আবু জাহির ভাগ বসিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গণপূর্ত ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের কাজেও ঠিকাদারেরা স্বস্তি পাননি। কখনো উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিয়েছেন, আবার কখনো অন্য ঠিকাদার কাজ পেলেও নিজের লোকজন দিয়ে কাজ করিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ঠিকাদারেরা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে হবিগঞ্জ শহরের খোয়াই নদের ওপর সেতু নির্মাণ ও ৯৩ দশমিক ২ মিটার রাস্তা নির্মাণে ১২ কোটি ২১ লাখ ৪৬ হাজার টাকার কাজ পায় খুলনার মোজাহের এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেড। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি নিজে এ কাজ করতে পারেনি। আবু জাহির পছন্দের ঠিকাদারের মাধ্যমে পুরো কাজ নিজেই করেন।
২০২০-২১ অর্থবছরে হবিগঞ্জ শহরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে চৌধুরীবাজার রাস্তা নির্মাণ ও শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জ-শেরপুর রাস্তা মেরামতসহ মোট ১০ কোটি ৫৪ লাখ ৯৭ হাজার টাকার কাজ পায় ঢাকার হাসান টেকনো বিল্ডার্স, মেসার্স জন্মভূমি নির্মাতা ও ওয়াহিদুজ্জামান চৌধুরীর যৌথ প্রতিষ্ঠান। তারা কাগজে-কলমে এ কাজের ঠিকাদার থাকলেও আবু জাহির তাঁর পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে পুরো কাজ সম্পন্ন করেন।
ওয়াহিদুজ্জামান চৌধুরী ও হাসান টেকনো বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী রাহাত হাসান স্বীকার করেছেন, তাঁরা কাজগুলো পেলেও আবু জাহির নিজের পছন্দের লোকজন দিয়ে সম্পন্ন করান।
গণপূর্ত ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের কাজেও ঠিকাদারেরা স্বস্তি পাননি। কখনো উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিয়েছেন, আবার কখনো অন্য ঠিকাদার কাজ পেলেও নিজের লোকজন দিয়ে কাজ করিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ঠিকাদারেরা।
হবিগঞ্জে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ খাত থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে আবু জাহিরের বিরুদ্ধে। জেলার চুনারুঘাটের সীমান্তবর্তী কেদারাকোর্ট এলাকায় অবস্থিত বাল্লা শুল্কস্টেশনকে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নে ৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের জন্য উপজেলার গাজীপুর মৌজার অধীনে সরকার ৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় ১৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
গাজীপুর এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণের আগেই আবু জাহির মালিকদের কাছ থেকে একটি দর নির্ধারণ করে মৌখিকভাবে জমিগুলো কিনে নেন। পরে সেই দরেই জমি ছেড়ে দেন মালিকেরা। তবে সরকার কত দরে জমি অধিগ্রহণ করেছে, তা এলাকাবাসীর কাছে গোপন রাখা হয়। মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে জাহির কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। একইভাবে আবু জাহিরের নিজ গ্রাম হবিগঞ্জ সদর উপজেলার রিচি গ্রামে শেখ রাসেল আইটি পার্ক নির্মাণ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
হবিগঞ্জ শহরের খোয়াই নদের প্রতিরক্ষা বাঁধের ভেতর থেকে বালু উত্তোলনে পরিবেশবাদীদের আপত্তি ছিল। তবু প্রতিবছর আবু জাহির প্রশাসনকে দিয়ে এ বালুমহালগুলো ইজারা দিতে বাধ্য করতেন। তাঁর পছন্দের লোকজনের নামে এ ইজারা নেওয়া হতো।
১৪৩০-৩১ বাংলা সনের জন্য খোয়াই নদের হবিগঞ্জ শহর অংশ ৩ কোটি ৫ লাখ টাকায় ইজারা পান সদর উপজেলার গঙ্গানগর গ্রামের মো. ফারুক মিয়া। এর আগের বছরও তিনিই ইজারা পেয়েছিলেন। ফারুক মিয়ার নামে ইজারা হলেও পেছনে ছিলেন আবু জাহির। ফারুক মিয়া স্বীকার করেছেন, তাঁর নামে ইজারা নেওয়া হলেও পুরো বিষয়টি তদারকি করতেন আবু জাহির।
এ ছাড়া জেলার চুনারুঘাট ও বাহুবল উপজেলায় নামে-বেনামে অনেকগুলো বালুমহালের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন আবু জাহির।
জেলার সবচেয়ে বড় জলমহাল হলো কচুয়া বিল, ধলেশ্বরী ও রবিয়ারকোনা-বাহারকোনা। এগুলো প্রতি তিন বছরের জন্য সরকার ইজারা দিয়ে থাকে। গত ১৬ বছর নানা সমিতির নামে মন্ত্রণালয় থেকে এসব জলমহাল ইজারা নিয়ে আসতেন আবু জাহির।
উপজেলার ভবানীপুর মৎস্য সমিতির সদস্য সুনীল সরকার বলেন, ‘আমরা মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের লোকজন ভয়ে গত ১৬ বছর কোনো জলমহাল ইজারা আনতে পারিনি।’
গাজীপুর এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণের আগেই আবু জাহির মালিকদের কাছ থেকে একটি দর নির্ধারণ করে মৌখিকভাবে জমিগুলো কিনে নেন। পরে সেই দরেই জমি ছেড়ে দেন মালিকেরা। তবে সরকার কত দরে জমি অধিগ্রহণ করেছে, তা এলাকাবাসীর কাছে গোপন রাখা হয়।
নিজের প্রভাব বাড়াতে আবু জাহির গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনে পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের ভিড়িয়েছেন। তাঁর প্রভাবেই স্বজনেরা স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন।
আবু জাহিরের স্ত্রী আলেয়া আখতার জেলা মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক। ছেলে ইফাত জামিল জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। জাহিরের ভাই বদরুল আলম জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ভাগনে আতাউর রহমান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ভাতিজা ফয়জুর রহমান জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।
আওয়ামী লীগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের আটজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, আবু জাহিরের মতের বাইরে দলের কোনো নেতা-কর্মী কথা বলতে পারতেন না। জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে ৬টিতে আওয়ামী লীগের কমিটি রয়েছে।
আবু জাহির নিজের প্রভাব খাটিয়ে স্ত্রী আলেয়া আখতারকে হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাগনে আতাউর রহমানকে হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র, শ্যালক কামরুজ্জামান আল বশিরকে বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউপি চেয়ারম্যান এবং চাচাতো ভাই আবদুর রহিমকে রিচি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বানান।
পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিযোগের বিষয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বরে আবু জাহির প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার আত্মীয়স্বজন আওয়ামী লীগ করেন, এটা কি অপরাধ? সবাই তাঁদের যোগ্যতা অনুসারেই কমিটিতে এসেছেন।’
২০১৭ সালে ঈদের জামাতের আগে হবিগঞ্জ কেন্দ্রীয় ঈদগাহে দীর্ঘ সময় বক্তৃতা করছিলেন আবু জাহির। নামাজের সময় কাছাকাছি চলে আসায় মো. আরব আলী নামের এক ব্যক্তি সংসদ সদস্যকে দ্রুত বক্তব্য শেষ করার অনুরোধ জানান। এরপর সবার সামনে আরবকে শাসান জাহির। ওই দিন রাতেই সদর থানার পুলিশ আরব আলীকে গ্রেপ্তার করে। পরে একটি মাদক মামলায় কারাগারে পাঠানো করা হয় আরব আলীকে। মাদক মামলায় আরব জামিন পেলে সেদিনই তাঁর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় আরেকটি মামলা হয়।
ভিন্নমত দমনে এভাবে নানা সময় অসংখ্য মানুষকে আবু জাহির হয়রানি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় দৈনিক প্রভাকর পত্রিকার সাংবাদিক শোয়েব চৌধুরী সংসদ নির্বাচনে আবু জাহিরের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ২০১৬ সালের ৫ নভেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চারটি মামলা করা হয়। গ্রেপ্তার হয়ে তিন মাস কারাগারেও ছিলেন। সংবাদ প্রকাশ করায় স্থানীয় দৈনিক আমার হবিগঞ্জ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক সুশান্ত দাসগুপ্তের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা হয়।
এসব অভিযোগ নিয়ে ২০২৩ সালের ২৫ নভেম্বর প্রথম আলোয় ‘ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছেন জাহির’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন আবু জাহির প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘অযথা হেনস্তা করার কারণই নেই। যাঁরা সাংবাদিকতার নামে সাংঘাতিকতা করেন, যাঁরা আমাদের মানসম্মান ক্ষুণ্ন করেন, এঁরা তো আইনের ঊর্ধ্বে নন।’
পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিযোগের বিষয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বরে আবু জাহির প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার আত্মীয়স্বজন আওয়ামী লীগ করেন, এটা কি অপরাধ? সবাই তাঁদের যোগ্যতা অনুসারেই কমিটিতে এসেছেন।’
১৫ বছর আগে আবু জাহির ও তাঁর স্ত্রীর ৩১ ভরি সোনা ছিল। টানা তিন মেয়াদের সংসদ সদস্য থাকার পর এই পরিবারের সোনার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩৯ ভরিতে। এর মধ্যে ১০৮ ভরি তাঁর ছেলে ইফাত জামিলের। একই সময়ে স্ত্রী ও ছেলের বার্ষিক আয় বেড়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। গত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাহিরের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামা পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
হলফনামা ঘেঁটে দেখা গেছে, আইনে স্নাতক আবু জাহিরের ২০০৮ সালে বার্ষিক আয় ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৯০ টাকা। ২০২৩ সালে তাঁর বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৭ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে তাঁর স্ত্রীর ৯ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৪ টাকার অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদ ছিল। ২০২৩ সালের হলফনামায় জাহির উল্লেখ করেছেন, তাঁর স্ত্রীর ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকার সম্পদ আছে।
আবু জাহিরের সময়ে আমরা দেখতে পেয়েছি সমাজে দখলদারত্ব, আধিপত্য ও নানা অনিয়ম। তাঁর একক আধিপত্যের কারণে সমাজে একধরনের অস্থিরতা ও ভীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়। আমরা চাই জবাবদিহির সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠুক। আবু জাহিরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে কেউ আর আগামী দিনে অপরাধজগৎ গড়ে তুলতে সাহস পাবে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী মিছবাউল বারী
গত ৪ আগস্ট আন্দোলনকারীরা হবিগঞ্জ শহরে মিছিল বের করলে আবু জাহিরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালান বলে অভিযোগ ওঠে। পরে আন্দোলনকারীরা ধাওয়া দিলে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা টাউন হল সড়কে আবু জাহিরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপর কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেন। এভাবে চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর রাত সাড়ে নয়টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি দল আবু জাহিরসহ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সার্কিট হাউসে নিয়ে আসে। পরদিন ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে আত্মগোপনে আছেন আবু জাহির। ফলে তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী মিছবাউল বারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবু জাহিরের সময়ে আমরা দেখতে পেয়েছি সমাজে দখলদারত্ব, আধিপত্য ও নানা অনিয়ম। তাঁর একক আধিপত্যের কারণে সমাজে একধরনের অস্থিরতা ও ভীতির সংস্কৃতি তৈরি হয়। আমরা চাই জবাবদিহির সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠুক। আবু জাহিরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে কেউ আর আগামী দিনে অপরাধজগৎ গড়ে তুলতে সাহস পাবে না।’