ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষে প্রাণ হারান তিন ছাত্র। এরপর কলেজটির রাজনীতির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয় ছাত্রলীগ। প্রায় ৩৫ বছর পর আবারও কলেজটিতে প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করেছে ছাত্রশিবির। পালন করা হচ্ছে নানা কর্মসূচি।
কলেজটির নাম চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ। চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ এলাকায় অবস্থিত এই কলেজ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৭ সালে। তখন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘চট্টগ্রাম কলেজ অব কমার্স’। গত সোমবার কলেজটিতে শেষ হয়েছে শিবিরের আয়োজন করা দুই দিনের প্রকাশনা উৎসব।
১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব দেখা গেছে এই কলেজের শিক্ষার্থীদের। কলেজটির ছাত্র সংসদে নেতৃত্ব দিয়েছেন—এমন অনেকেই দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়েরও। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে কলেজটিতে সব ছাত্রসংগঠনের অংশগ্রহণে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার রীতি ছিল। তবে সেই দৃশ্যপট পাল্টে যায় নব্বইয়ের দশকে।
কলেজটির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন—এমন নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালের দিকে কলেজে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয় ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে। এতে প্রাণ হারান তিন ছাত্র। এরপর কলেজটি পুরোপুরি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। একসময় প্রকাশ্যে রাজনীতি করা ছাত্রশিবিরের কার্যক্রমও কলেজে বন্ধ হয়ে পড়ে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কলেজের রাজনৈতিক দৃশ্যপট আবারও পাল্টে গেছে। কলেজটিতে আবারও প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। গত বছরের নভেম্বরে প্রথম প্রকাশ্যে আসে সংগঠনের কলেজ শাখার কমিটিও। গত রোববার থেকে গত সোমবার পর্যন্ত এই কলেজে আয়োজন করা হয় ছাত্রশিবিরের প্রকাশনা উৎসব। আয়োজক ইসলামী ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম নগর দক্ষিণ শাখা।
গত সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, কলেজের ফটকের উল্টো দিকে সড়কের পাশে বসানো হয়েছে তিনটি স্টল। পাশে ‘রিডিং কর্নার’। বইয়ের পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনের ছবিযুক্ত ক্যালেন্ডারও প্রদর্শন করা হচ্ছে এসব স্টলে। এ ছাড়া পাশে একটি বুথে ছাত্রশিবিরের সমর্থক ফরম পূরণের সুযোগ রাখা হয়েছে। জানতে চাইলে মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিবির নিয়ে মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছিল। এই বিভ্রান্তি দূর করতেই সংগঠনের প্রকাশনা নিয়ে উৎসবের আয়োজন।
ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা জানান, কলেজটিতে দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে শিবিরের রাজনীতি না থাকলেও সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল না। সাংগঠনিক থানা হিসেবে প্রতিবছর কমিটিও করা হয়।
শিবিরের প্রকাশনা উৎসব। গত সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের সামনেছবি: সংগৃহীত
শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে কমার্স কলেজের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের। এরপর সেখানে গত সেপ্টেম্বর মাসের দিকে আহ্বায়ক কমিটি দেয় ছাত্রদল। গত ২৩ নভেম্বর কলেজের উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শিবির। সেখানে প্রথম প্রকাশ্যে আসেন কমার্স কলেজ শাখা শিবিরের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম। এরপর গত ডিসেম্বর মাসে বিজয় শোভাযাত্রা আয়োজন করা হয়। এ বছর কমার্স কলেজ শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের সাদনান ফাহিম।
কমার্স কলেজ শাখা শিবিরের সভাপতি সাদনান ফাহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁদের জন্য কাজ করতে চাই। ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে যে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের, আমরা সেটি দূর করতে চাই। সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলেজে শিবিরের কার্যক্রম চলছে।’
কলেজ ছাত্রলীগের নেতাদের অধিকাংশই বর্তমানে আত্মগোপনে। তাই তাঁদের কোনো বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদলের সদস্যসচিব শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক সহাবস্থানে থাকতে চাই। আমরা চাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়। পাশাপাশি শিবিরকেও গুপ্ত রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতি করার আহ্বান জানাই’