এ সরকার কি আগের সরকারের মতোই কাজ করছে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 21-01-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

গত শনিবার ‘শ্বেতপত্র ও অতঃপর: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক আলোচনায় অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদেরা কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি। সবার কণ্ঠে ছিল হতাশার সুর। তাঁদের অভিযোগ, অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে যতটা মনোযোগ দিচ্ছে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ততটা দিচ্ছে না। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন জমা হওয়ার দেড় মাস পার হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার কিছুই করেনি। অবিবেচনাপ্রসূতভাবে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে। 

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য অনেকগুলো কমিশন করলেও অর্থনৈতিক সংস্কারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ও শ্বেতপত্র প্রকাশ কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘অনেকের মতে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ সরকার আগের সরকারের মতোই কাজ করছে।’

 

জনগণের প্রশ্ন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যদি অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের মতোই কাজ করে থাকে, তাহলে জুলাই-আগস্টে এত বড় গণ-অভ্যুত্থান কেন ঘটল? কেন এত মানুষ জীবন দিলেন? বৈষম্যবিরোধী স্লোগান সামনে রেখে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান হলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের মনোযোগ কম উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত বাজেটের অধীনই পরিচালিত হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশোধিত বাজেট পেশ না করায় আগের বাজেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সূচকই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ফলে যারা কর দেয় না, তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—জানা গেল না, যা চিন্তিত করেছে। আগামী গ্রীষ্মকালে জ্বালানি পরিস্থিতি আরও জটিল হবে বলেও আশঙ্কা করছেন এই অর্থনীতিবিদ। 

বিশ্বব্যাংক ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ (বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা) শীর্ষক প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ১ শতাংশে নামতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) অর্থনীতিতে পাঁচটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে—উচ্চ মূল্যস্ফীতি, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া (বন্যা, তাপপ্রবাহ), দূষণ (বায়ু, পানি, মাটি), বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব এবং অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা (মন্দা, স্থবিরতা)। এর মধ্যে সবগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে বাস্তবমুখী ও গণবান্ধব কর্মসূচি তো নিতে পারে। 

 

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যে দেশে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার ঝুঁকি বেড়েছে, তার প্রতিকারে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গঠন করা হয়নি কোনো কমিশন। তাহলে কি দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের অভিযোগই সত্য যে সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে যতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, অর্থনৈতিক সংস্কারকে দিচ্ছে না। সরকারের নীতিনির্ধারকদের তো জানা উচিত যে মানুষকে অভুক্ত রেখে কোনো সংস্কার কর্মসূচিই কাজে আসবে না। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। নতুন সরকারকেও খুব ভিন্ন কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মূল্যস্ফীতির কথা উল্লেখ করে বলেন, পণ্যমূল্যে আগুন বহির্বিশ্বে নিভে গেলেও বাংলাদেশে নেভেনি। না নেভার কারণও আছে। ফায়ার ব্রিগেড দেরিতে এসেছে। এসে আবার পানি ঢালার বদলে তেল ঢেলেছে। পরে দেখা গেল, পাইপেও সমস্যা আছে। তাঁর এই বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যে বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে আমাদের এখানে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছিল, সেই বিশ্ববাজারে দাম কমে গেছে। কিন্তু আমাদের এখানে কেন দ্রব্যমূল্যের আগুন নিভল না, সে প্রশ্নের জবাব কে দেবে? 

ওই দিনের সেমিনারে সবচেয়ে উদ্বেগের কথাটি বলেছেন ব্যবসায়ী সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, ‘৩৪ বছর ধরে দেশে ব্যবসা করি। এমন টানাপোড়েন পুরো ব্যবসায়িক সময়ে দেখিনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগ অন্য দেশে চলে যাবে।’ ৩৪ বছরের মধ্যে যদি এখন ব্যবসায়ীদের জন্য সবচেয়ে দুঃসময় হয়, সুসময়টি কবে আসবে, কারা আনবেন।

অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমানের গতকাল রোববার প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারেও অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, অর্থনীতিকে বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকার কিছুটা সফল হলেও অর্থনীতিকে বেগবান করতে পারেনি। শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারও পুরোনো পথকেই সহজ পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে।’ আওয়ামী লীগ সরকার আইএমএফের শর্ত মেনে ঋণ নিয়েছিল। 

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে যখন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড বাহাস হচ্ছে, সর্বদলীয় বৈঠকেও যখন সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না, তখন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষের অবস্থা কী। খেটে খাওয়া যে মানুষেরা জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, ৫ আগস্টের পর তাঁরা নিজ নিজ পেশায় ফিরে গেছেন। তাঁদের কেউ আন্দোলনের কৃতিত্ব নেওয়ার কথা ভাবেন না, কিংবা আগামী নির্বাচনে প্রার্থীও হবেন না। কিন্তু এই নামহীন মানুষগুলো একটু স্বস্তি চেয়েছিলেন, যা তাঁরা পাননি; বরং বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি তাঁদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলেছে। 

গত ১৫ ডিসেম্বর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‍্যাপিড) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০২২ সালের পরের দুই বছরে ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের মানুষের ক্রয়সক্ষমতা কমেছে, এতে নতুন করে ৭৮ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমায় এসেছে, আর প্রায় ১ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকির মধ্যে এসেছে। এর মধ্যে আগে দরিদ্র ছিল—এমন মানুষের মধ্যে ৩৮ লাখ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ নতুন করে হয় দরিদ্র হয়েছে বা দারিদ্র্যের ঝুঁকির মধ্যে এসেছে—উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সেভাবে আয় না বাড়ার ব্যবধানের কারণে।

গত ১৮ অক্টোবর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের অবস্থা গুরুতর।

‘বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক-২০২৪: সংঘাতের মধ্যে দারিদ্র্য’ শিরোনামের এই প্রতিবেদন গত বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হয়। বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক-২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে মানুষের জীবনযাত্রার মান (৪৫ দশমিক ১ শতাংশ)। এরপর রয়েছে শিক্ষা (৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ) ও স্বাস্থ্য (১৭ দশমিক ৩ শতাংশ)।

লেখার শুরুতে শ্বেতপত্রের কথা উল্লেখ করেছি। কমিটি দেড় মাস আগে প্রতিবেদন জমা দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। এর বাইরে সরকার ১১টি কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে চারটি কমিশন যথাক্রমে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো চলতি মাসের মধ্যে দেওয়ার কথা। এরপর আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে সরকার অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে জানানো হয়েছে। 

 

দেশকে গণতন্ত্রায়ণের পথে নিয়ে যেতে এসব হয়তো খুবই ভালো উদ্যোগ। 

কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যে দেশে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার ঝুঁকি বেড়েছে, তার প্রতিকারে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গঠন করা হয়নি কোনো কমিশন। তাহলে কি দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের অভিযোগই সত্য যে সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে যতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, অর্থনৈতিক সংস্কারকে দিচ্ছে না। সরকারের নীতিনির্ধারকদের তো জানা উচিত যে মানুষকে অভুক্ত রেখে কোনো সংস্কার কর্মসূচিই কাজে আসবে না। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

শেয়ার করুন