দোতলা পাকা বাড়িটির পলেস্তারায় যথেষ্টই বয়সের ছাপ। এখানে–সেখানে গজিয়েছে বট–পাকুড়। তবে এই বাড়ি পরিত্যক্ত নয়। মানুষ বসবাস করে। ‘আমরা ছোটবেলায় এই বাড়ির ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতাম। ছাদ থেকে দেখা যেত পুরো পাথরাইল,’ বললেন টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সীতারাম–রণজিৎ বসাকের অন্যতম স্বত্বাধিকারী সুবীর বসাক। সুবীরের বয়স ৪০ ছুঁইছুঁই। দালানের সামনে কিছুটা তফাতে টিনের চাল ছাওয়া বারান্দাওয়ালা একটা পরিত্যক্ত ঘর দেখিয়ে সুবীর বলেন, ‘এটা ছিল কাছারিঘর। আর বারান্দায় যে হাতলওয়ালা হেলান দেওয়া বড় বেঞ্চটা দেখছেন, বাড়িতে অতিথি এলে এই বেঞ্চ নিয়ে যেতাম। অনেক ওজন। কয়েকজন মিলে তুলতে হতো।’
এটা কালিকা বসাকের বাড়ি। বাড়ির উঠানে গল্পরত দু–তিনজন বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, গত শতকের চল্লিশের দশকে তৈরি হয়েছিল এই বাড়ি। প্রথমে ছিল একতলা, পরে দোতলা। এটা তখন ‘ধনী বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। এটাই টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নের প্রথম দালান, অর্থাৎ পাকা বাড়ি। বাড়ির নির্মাতা আকালী বসাকের ছিল শাড়ির ব্যবসা। সেটা ছোট পরিসরে ধরে রেখেছেন তাঁর উত্তরসূরি অনিক বসাক ও যুক্ত বসাক।
এই বাড়িটি এক সময় ছিল ওই এলাকার একমাত্র পাকা দালান, এখন বাড়িটির রুগ্ন দশাছবি: কবির হোসেন
ধনী বাড়ির সেই জৌলুশ আর এখন নেই। তবে বেড়েছে পাথরাইল ও চণ্ডীর জৌলুশ। গ্রাম দুটি টাঙ্গাইল–দেলদুয়ার পাকা সড়কের দুই পাশে। এই দুই গ্রামকেই বলা যায় টাঙ্গাইল শাড়ির বাণিজ্যিক রাজধানী। সারি সারি দালান, একই সঙ্গে শাড়ির দোকান ও বসতবাড়ি। দেশের কোনো গ্রামে এত চকচকে দালানকোঠা চোখে পড়বে কি না, সন্দেহ। ওই যে ধনী বাড়ির কথা বললাম, সেটার পর পাথরাইলে আরও দালান উঠতে সময় লেগেছে প্রায় অর্ধশতাব্দী।
আমাদের সঙ্গী প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কামনাশীষ শেখর বললেন, ‘মূলত টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের মুনিরা এমদাদের হাত ধরেই গত শতকের আশির দশকে ঢাকাতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে টাঙ্গাইল শাড়ি।’ পাথরাইল ও চণ্ডী গ্রামে রমরমা হয়ে ওঠে ব্যবসা–বাণিজ্য। বংশপরম্পরায় এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত তাঁতশিল্পীদের কপাল খুলে যায়। এখন তো টাঙ্গাইল শাড়ি ছাড়া দেশের কোনো ফ্যাশন হাউসই চলে না। পুনরুত্থানের আগে এই গ্রামে তাঁতশিল্পীদের বাড়ি খুব বড়জোর ঢেউটিনে ছাওয়া ছিল। টাঙ্গাইল শাড়িই তাঁদের সচ্ছলতা দিয়েছে, দিয়েছে পাকা দালানকোঠা।
বাড়িতেই শাড়ির দোকান। যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড সন্সছবি: কবির হোসেন
যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী এবং টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাকের দোকান ও বাড়ি চণ্ডী গ্রামে। তাঁর বাড়ি তিনতলা। রয়েছে লিফট। রঘুনাথ বললেন, ‘আগে বাড়িঘর ছিল অবহেলিত। এখন বেশির ভাগ ব্যবসায়ীরই পাকা বাড়ি। বেশির ভাগই দোতলা–তিনতলা। আমার ভাই রতন বসাকের বাড়ি চারতলা। বাড়িটি বাবার নামেই করেছি। আমাদের বাড়ি শোরুমসহই ভাবা হয়।’
পাথরাইল ও চণ্ডীতে মূলত টাঙ্গাইল শাড়ি ও তাঁতে বোনা থ্রি–পিস, ওড়না ইত্যাদি পাইকারি বিক্রি হয়। খুচরা বিক্রি মূল ব্যবসা নয়। অনেক ফ্যাশন হাউস ও খুচরা বিক্রেতা আসেন। তাই একটু বড় পরিসরেই বাড়ি ও দোকান তৈরি করেন তাঁরা। কম বাড়িই স্থপতির নকশায় নির্মিত হয়েছে। বাড়িগুলোতে টাইলস, ইস্পাতের গ্রিল, থাই অ্যালুমিনিয়াম, কাচ ব্যবহারের চলতি ধারাই বেশি দেখা যায়। তবে বাড়ি নির্মাণের সময় পুরকৌশলীর (সিভিল ইঞ্জিনিয়ার) কাছ থেকে ইট–বালু–রড–সিমেন্টের সঠিক হিসাবটা নিয়ে নেন তাঁরা।
পুরো গ্রামেই এখন সারি সারি দালানছবি: কবির হোসেন
বেশির ভাগ বাড়িতেই গ্যারেজ রয়েছে। রঘুনাথ বসাক বলেন, আগে ঢাকা থেকে অনেক ক্রেতা গাড়ি নিয়ে আসতেন। করোনা মহামারির পর ব্যবসা কমেছে, ধরনও পাল্টেছে। ব্যবসায়ীদের নিজেদের গাড়িও এখন তেমন নেই। ২০২০ সালে বাংলা নববর্ষে ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু করোনার কারণে পয়লা বৈশাখের ব্যবসা কিছুই হয়নি। অনেকের ব্যবসাই এতে বসে পড়ে। ২০১১ সালে বাড়িটি করেছেন রঘুনাথ বসাক। আর ২০২১ সালে লিফট।
বাড়ির গেটে সিংহমূর্তিছবি: কবির হোসেন
পাথরাইল গ্রামেই নিমাই–মন্টু বসাকের বাড়িতে দেখা গেল সিংহদুয়ার। প্রধান ফটকের খিলানের ওপর শোভা পাচ্ছে সিংহমূর্তি। রতন বসাকের চারতলা বাড়ির ফটকটাও কিন্তু দেখার মতো। আধুনিক স্থাপত্যের ছাপ আছে।
এমন রান্নাঘর শহুরে বাড়িতেও খুঁজে পাওয়া কঠিনছবি: কবির হোসেন
দুই গ্রাম মিলিয়ে সবচেয়ে দৃষ্টনন্দন বাড়িটি সীতারাম–রণজিৎ বসাকদের। এই দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের ছেলেরা এখন স্বত্বাধিকারী। আগের দোতলা দোকানটা এখন পরিত্যক্ত। নতুন শোরুম হয়েছে। শোরুমের পাশেই তাঁদের বসতবাড়ি। পুরোনো টিনের ঘরটি আছে। পাশেই বর্তমান স্বত্বাধিকারী সুবীর বসাক ও পলাশ বানিয়েছেন তিনতলা দালান। সুবীর বলেন, ‘ডিজাইন আমাদেরই করা। তবে ইঞ্জিনিয়ার সব মাপজোখ করে দিয়েছেন।’
বাড়ির পাশেই সিরামিক ইটের একতলা আরেকটি ঘর। বাইরে থেকে মনে হয় থাকার ঘর। আসলে এটি রান্না ও খাবার ঘর। থাকার বাড়ির সঙ্গে করিডর দিয়ে সংযুক্ত। সুবীর বলেন, ‘যখন দালান করলাম, তখন গ্রামের অনেকেই বলতে লাগল, নিজেরা তো দালান বানিয়েছ, কিন্তু মা–কাকিরা তো গরমের মধ্যেই রান্না করে। এ জন্য আধুনিক নকশায় রান্নাঘর করে দিই আমরা। সে ঘরে এসিও রয়েছে।’ এই ঘরের ছাদটা আড্ডা দেওয়ার উপযোগী করে সাজানো হয়েছে। টিনের একটা ছাউনি রয়েছে, যেটাতে কারুকাজ। ২০১০ সালে সুবীরের বাবা সীতারাম বসাক যখন বাড়িটি বানান, তখন এটা ছিল দোতলা। ২০২৩ সালে তোলা হয় আরও একতলা। পাথরাইল–চণ্ডীর আর সব পরিবারের মতো সুবীরদেরও একান্নবর্তী পরিবার। এখানকার বাড়িগুলোর এটাও একটা বৈশিষ্ট্য। এ বাড়ির উঠানের ডান পাশে মন্দির। শ্বেতশুভ্র মন্দিরের সিঁড়ি ও মেঝেতে ব্যবহার করা হয়েছে মর্মর পাথর। উঠানে বড় একটা খাঁচায় একটা ময়না। মাঝেমধ্যেই বলে উঠছে ‘হরে কৃষ্ণ’, ‘হরে কৃষ্ণ’।
বদলে গেছে টাঙ্গাইল শাড়ির এই গ্রামছবি: কবির হোসেন
কয়েক বছর আগে তিন কাঠা জমি কিনে তিনতলা বাড়ি করেছেন রাধেশ্যাম নীলকমল বসাক। এটার নিচতলা অন্য বাড়িগুলোর মতোই শোরুম, কাচে ঘেরা। দোতলা ও তিনতলা আধুনিক নকশার বাড়ি। বড় বড় জানালায় নীল কাচ। নীলকমল বসাক বললেন, দোতলা আর তিনতলা আসলে অতিথিদের জন্য। শাড়ি কিনতে যাঁরা আসেন, তাঁদের বিশ্রাম বা থাকার জন্য। আমরা এ বাড়িতে থাকি না।’
আধাপাকা বাংলোবাড়িছবি: কবির হোসেন
এই দালানের পাশে একটু দূরে নীলকমলের বাংলোবাড়ি। টিনের কারুকাজ করা। এটাও তাঁদের ক্রেতা ও অতিথিদের জন্য। তাহলে তাঁরা থাকেন কই? নীলকমল বললেন, ‘বাংলোর কাছেই আমাদের বাপ–ঠাকুরদাদের টিনের বসতবাড়ি। প্রায় ১০০ বছর আগে তৈরি। আমি ও আমার পরিবার সেই বাড়িতেই থাকি।’
তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইল শাড়িছবি: কবির হোসেন
পাথরাইল ও চণ্ডী গ্রামে ৭০ থেকে ৭৫টি পাকা বাড়ি আছে। সর্বোচ্চ ৮ তলার একটা দালানও চোখে পড়ল, মূল সড়কের পাশে। তবে এটা বসতবাড়ি নয়, বাণিজ্যিক ভবন। যথারীতি এখানেও আছে বেশ কয়েকটি শাড়ির দোকান, অবশ্যই পাইকারি।
টাঙ্গাইল শাড়ির পুনরুত্থানের যে ইতিহাস, তাঁতশিল্পীদের অবস্থার যে পরিবর্তন, তা এই দুই গ্রামই প্রমাণ দেয়। আর প্রামাণ্য দলিল তো এই সারি সারি ঝাঁ–চকচকে পাকা বাড়ি।
(লেখাটি বর্ণিল বসত নভেম্বর ২০২৪–সংখ্যায় প্রকাশিত)