যখন হিজবুল্লাহর প্রয়াত মহাসচিব হাসান নাসরুল্লাহ মাটির ৬০ ফুট নিচে একটি বাংকারে বাস্টিং বোমায় নিহত হন, ইসরায়েলের রাস্তায় ছিল উল্লাস। তাদের পত্রিকা লিখল, ‘নাসরুল্লাহ মারা গেছেন এবং হিজবুল্লাহ ভেঙে গেছে।’
এ ঘটনার মাত্র দুই মাস পর ইসরায়েলের মেজাজ একেবারেই বদলে গেল। মাত্র ১১ দিন আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছিলেন যে তাঁদের ছিল হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করা এবং দক্ষিণ লেবাননে একটি বাফার জোন তৈরি করা। তাঁদের সেনাবাহিনী কোনোটিই করতে পারেনি। ইসরায়েলিরা তখনো তা জানতেন না।
প্রায় ১৪ মাস লড়াইয়ের পর ‘কে জিতেছে’, তা নিয়ে একটি জরিপ হয়েছিল। সেই জরিপে ২০ শতাংশ ইসরায়েলি বলেছেন যে ইসরায়েল জিতেছে। ১৯ শতাংশ বলেছেন, হিজবুল্লাহ জিতেছে। ৫০ শতাংশ লোক বলেছেন যে কোনো স্পষ্ট জয়-পরাজয় ছাড়াই লড়াই শেষ হতে চলেছে। আর ১১ শতাংশ বলেছেন যে তাঁরা এর উত্তর জানেন না।
তবে এটা অনস্বীকার্য যে এই কথিত ‘দুর্বল’ হিজবুল্লাহ ১৯৮২ সালের তুলনায় অনেক বেশি শক্তভাবে লড়েছে। আর ২০০৬ সালে ইসরায়েলি সৈন্যরা বৈরুতে পৌঁছাতে মাত্র পাঁচ দিন সময় নিয়েছিলেন।
গাজায় গত ১৩ মাসের যুদ্ধ দেখা গেছে, সুন্নি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন এখন শিয়া লেবাননের আন্দোলনের সঙ্গে মিলে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দিতে পারে। পুরো অঞ্চলে সুন্নি এবং শিয়া শক্তিকে পুনরায় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। ভাগ করে শাসন করো নীতিকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলকে শান্ত রাখার নীতি ইসরায়েলের জন্য আর আগের মতো কাজ করছে না।
সুন্নি আরব দুনিয়ায় একটা বড় মনোজাগতিক বদল ঘটে গেছে। এই পরিবর্তন অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে বলে ভাবা যায়নি। এর জন্য ইসরায়েল বা আমেরিকা প্রস্তুত ছিল না। আর তা হচ্ছে, ইসরায়েলকে স্বীকার করে নিয়ে আসলে এই অঞ্চলে আর শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অর্থনৈতিক, সামরিক আর প্রযুক্তিগত আধিপত্য আর প্রশ্নহীনভাবে ছেড়ে দিতে রাজি নয় অধিকাংশ দেশ।
এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে বর্তমান সৌদি নেতৃত্বেও বিগত বহু বছরের অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে। তাঁরা এখন ফিলিস্তিন প্রশ্নে অনেক বেশি খোলাখুলি তাঁদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। এর জন্য হয়তো সাম্প্রতিক সময়ে দেশের জনগণের উত্তাল প্রতিবাদ বড় ভূমিকা রেখেছে। বেশ কয়েক দশক হিমাগারে থাকার পর আরব জাতীয়তাবাদ এবং দখলদারত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ এসে মিলেছে ইসলামের পতাকাতলে।
হিজবুল্লাহ আবারও প্রমাণ করেছে, ইসরায়েলের এই কট্টর শত্রুকে নির্মূল করা যাবে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ইসরায়েল ও আমেরিকার ভুল ভাঙাবে কে? যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে হিজবুল্লাহর সিদ্ধান্তকে তারা ‘আত্মসমর্পণ’ বলে ভাবছে এখনো। সেই রকম আশা নিয়ে ইসরায়েল গাজায় ধ্বংসস্তূপ তৈরি করে যাচ্ছে।
নেতানিয়াহু এখন রাজনীতিতে জুয়া খেলছেন। কিন্তু তাঁর নিজের হাতে পুঁজি কম। আগেই তিনি অনেক ঋণ নিয়ে রেখেছেন। আরও বেশি ঋণ নিয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাঁর হাতে আসলে এখন তাস খুবই কম।
হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যুর পরও তারা ভেবেছে, হামাস ভেঙে পড়বে। কিন্তু হামাস উত্তর গাজার নরকে বাস করেও প্রতিরোধ অটুট রেখেছে। মনে রাখবেন, সেখানে ৫০ দিন ধরে সব ধরনের খাদ্যসরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
কিন্তু আমেরিকা আর ইসরায়েল বিশ্লেষণের ছদ্মবেশে নিজেরা যা চায়, সেটাই বলে।
গত ১৪ মাসে গাজায় এমন ক্ষয়ক্ষতি পরও হামাস সাদা পতাকা হাতে এগোবে বলে মনে হয় না। নেতানিয়াহু এক চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। সেই চুক্তি তাঁর ঘোষিত সামরিক লক্ষ্যের ধারেকাছেও নেই। ব্যাপারটা হামাসকে আশা জোগাচ্ছে।
গাজায় জর্জরিত, লেবাননে বিতাড়িত হয়ে নেতানিয়াহু এখন ব্যস্ত ইরানে হামলার প্রয়োজনীয়তার দিকে ট্রাম্পের মনোযোগ আকর্ষণ করতে। আবার ইরানের ওপর আক্রমণ করার জন্য পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম ক্ষেত্র তৈরি করেই রেখেছে। সর্বশেষ হামলায় দেশটির বিমান প্রতিরক্ষাকে ধ্বংস হয়েছে অনেকখানি। তাই আমেরিকা আর ইসরায়েল ভাবছে, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো হামলার জন্য একেবারে সহজ লক্ষ্য।
ওয়াকিবহাল ইরানি সূত্রে জানা গেছে, আসল ঘটনা একেবারেই ভিন্ন। একটা সক্রিয় শীর্ষ-গোপন পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণাকেন্দ্র বলে দাবি করা হয় পারচিনকে। এই কেন্দ্রের কাছাকাছি বসবাসকারী সূত্র অনুসারে, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পারচিনে আঘাত করতে পারেনি। পারচিন সামরিক মিলিটারি কমপ্লেক্সের সব গিয়ার অনেক আগেই পাহাড়ে সরানো হয়েছিল। অন্য একটি জায়গায় ড্রোন আক্রমণ করা হয়েছে। তবে সেই আক্রমণ হয়েছে কাস্পিয়ান সাগরের দিক থেকে। সেটা ইসরায়েলি স্ট্রাইক ফোর্স করেনি।
ইরানে আবার আক্রমণ হবে কি না, তা বাইডেনের বিদায়ী প্রশাসন, নেতানিয়াহু আর তাঁর ডিপ স্টেটের জটিল খেলাই নির্ধারণ করবে। কিছুদিন পরই আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প আসার পর কী রকম করে কী করতে চাইবেন, এই খেলায় সেটাও বিবেচনায় রাখা হবে নিশ্চয়ই। সেগুলো আগে থেকে আন্দাজ করা এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তবে যা–ই হোক না কেন, ইরানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি কাছাকাছি। গাজা, লেবানন বা ইরান—আসলে কোনো জায়গা থেকেই নেতানিয়াহুর জন্য সুসংবাদ আসছে না। নিজের দেশেও তিনি বিরোধিতার ঝড়ের মুখোমুখি হচ্ছেন। তাঁর সেনাবাহিনী ক্লান্ত। সেখান থেকেও এখন মনে হয় বিরোধিতা আসবে। যেসব জিম্মি জীবিত আছেন, তাঁদের পরিবার হতাশ। নিজেদের আপনজনকে নিয়ে কেবল রাজনীতি করায় তাঁরা বিরক্ত। আদালতে আসছে সরকারের নামে দুর্নীতির অভিযোগ। বিরোধী দল নেতানিয়াহুকে প্রত্যহ সেই হুমকি দিচ্ছে।
নেতানিয়াহু এখন রাজনীতিতে জুয়া খেলছেন। কিন্তু তাঁর নিজের হাতে পুঁজি কম। আগেই তিনি অনেক ঋণ নিয়ে রেখেছেন। আরও বেশি ঋণ নিয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাঁর হাতে আসলে এখন তাস খুবই কম।
বাস্তবতা হলো, ইসরায়েল গত ১৪ মাসে যুদ্ধ করে খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু হারিয়েছে অনেক কিছু। এই সংঘাত নিয়ে সারা দুনিয়াকে নেতানিয়াহু যে গল্পগুলো শুনিয়ে আসছেন, তিনি নিজেই বোধহয় সেগুলো বিশ্বাস করে ফেলেছেন। এরসঙ্গে তাঁর একগুঁয়ে অভ্যাস তো আছেই।
ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সম্পাদক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত