আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র পাহাড়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে নেমেছে আঞ্চলিকদলগুলো। আধিপত্যের লড়াইয়ে লিপ্ত থাকা উপজাতীয়দের বিপদগামী আঞ্চলিকদলীয় সন্ত্রাসীরা তাদের সশস্ত্র তৎপরতার রসদ যোগানোসহ আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পাহাড়ের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারী অফিসগুলোতে বিগত বছরগুলোর চেয়ে অন্তত তিনগুন বেশি হারে চাঁদা দাবি করছে।
চলতি সপ্তাহে রাঙামাটি শহরেরই অদূরে সদর উপজেলাধীন মগবানের গুরগুইজ্জা ছড়ি এলাকায় পাহাড়ের সর্ববৃহৎ আঞ্চলিকদলের সন্ত্রাসীরা চাঁদা আদায়ের দাবিতে বনবিভাগের ৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারিকে আটকিয়ে রাখে। কয়েক ঘন্টা আটক রাখার পর ভবিষ্যতে চাঁদা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে তারা অফিসে ফিরে আসেন।
বনবিভাগের দায়িত্বশীল একজন উদ্বর্তন বিভাগীয় কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করলেও তিনি নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, আমরা বিষয়টি নিরসনের জন্য রাঙামাটির কাঠ ব্যবসায়ি সমিতিকে বলেছি। তারা যদি এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে নাপারে তাহলে আমাদের বনবিভাগের লোকজন মাঠ পর্যায়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করতে যেতে আগ্রহী হবে না।
এদিকে এই ঘটনার পর থেকেই রাঙামাটির বনবিভাগ কর্তৃক কাঠ ব্যবসায়িদের জন্য নির্ধারিত বৈধ পারমিট ইস্যু করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়িরা। যার ফলে গত এক সপ্তাহব্যাপী রাঙামাটি থেকে কোনো ধরনের কাঠবাহি ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে না বলে প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন রাঙামাটি কাঠ ব্যবসায়ি সমিতির সভাপতি হাজী মোঃ আজম খান চৌধুরী। তিনি জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে আমরা সমিতির পক্ষ থেকে সন্ত্রাসীদের কোনো ধরনের চাঁদা দেইনা।
একারনে সাম্প্রতিক সময়ে দুই বার কাঠভর্তি ট্রাকে গুলি চালিয়েছে পাহাড়ি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনার পর থেকেই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কাঠবাহি ট্রাকগুলো রাঙামাটি শহর থেকে ঘাগড়া পর্যন্ত নিরাপত্তা বেষ্টনি দিয়ে পৌছে দেওয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের নিকট আমরা কাঠ ব্যবসায়ি সমিতির পক্ষ থেকে কোনো ধরনের চাঁদা দিবো না এই ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে যে কোনো উদ্যোগ নিলে সেক্ষেত্রে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে।
রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ বলেছেন, চাঁদা দাবির কারনে কাঠের ব্যবসা বন্ধ রয়েছে এই বিষয়টি আমরা অবগত রয়েছি। তিনি জানান, মূলত অর্ন্তঘাতমূলক কর্মকান্ড ও আগামী নির্বাচনে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ব্যবহারের জন্য অস্ত্র ক্রয়ের লক্ষ্যে আঞ্চলিকদলীয় সন্ত্রাসীরা বর্তমানে দ্বিগুন থেকে তিনগুন হারে চাঁদা আদায়ের চেষ্ঠা করছে। তারই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ব্যবসায়ি থেকে শুরু করে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে বনবিভাগের কাছেও তারা হুমকি দিয়ে বলেছে যে, কাঠ ব্যবসায়িদের জন্য যাতে করে টিপি/পারমিট প্রদান না করা হয়। এমন দুঃসাহসও তারা দেখাচ্ছে।
এটি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয় মন্তব্য করে চেম্বার সভাপতি বলেন, আমরা ব্যবসায়িরা চাঁদামুক্ত পরিবেশে ব্যবসা করতে চাই। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য আমরাসহ আমাদের সদস্য সংগঠনগুলোর মধ্যে আসবাবপত্র ব্যবসায়ি সমিতি ও কাঠ ব্যবসায়ি সমিতি একটাকাও চাঁদা দেয়না। কিন্তু জোত মালিকদের কাছ থেকে বাগানে চাঁদা নেয় সন্ত্রাসীরা।
সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো সক্রিয় হওয়ার দাবি জানিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিকটস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্প বা ফাড়িঁতে অভিযোগ দেওয়ার আহবানও জানিয়েছেন তিনি। চাঁদাবাজদের রুখতে ইতিমধ্যেই ব্যবসায়িক সকল সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্ঠা চালানো হচ্ছে এবং এই ধরনের ব্যাপক চাঁদাবাজি বন্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলনে নামারমতো কঠোর কর্মসূচী দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন রাঙামাটি চেম্বারের সভাপতি।
এদিকে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সজাগ রয়েছে মন্তব্য করে রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ(বিপিএম-বার) বলেছেন, আমাদের কাছে বিষয়টি নিয়ে এখনো পর্যন্ত কেউই লিখিত অভিযোগ জানায়নি। তারপরও আমরা বিয়ষটি খতিয়ে দেখে জড়িতদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। পুলিশ সুপার বলেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সবধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কাউকেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে দেওয়া হবেনা। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং নির্বাচনের আগে-পরে যেকোনো অপতৎপরতা বন্ধে কঠোর অবস্থানে রাখা হয়েছে পুলিশ সদস্যদের। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করার আহবান জানিয়েছেন স্থানীয়দের। প্রয়োজনে তথ্য প্রদানকারি ব্যক্তির সার্বিক পরিচয় গোপন রাখা হবে বলেও জানিয়েছেন রাঙামাটির পুলিশ সুপার।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ০৯ ডিসেম্বর জোত ভুমি দেখার উদ্দেশ্যে বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে ০৬ সদস্যের একটি দল রাঙামাটি সদর উপজেলাধীন মগবান ইউনিয়নে গমন করলে পথিমধ্যে গরগইজ্জা ছড়া নামক এলাকায় গেলে পিসিজেএসএস এর ৫/৬ জন সদস্য বনবিভাগের লোকজনকে আটক করে। এবং তাহাদের মাধ্যমে রাঙামাটি কাঠ ব্যবসায়ি সমিতিকে পূর্বের ন্যায় গাড়ি প্রতি ৬হাজার টাকা চাঁদা প্রদানের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। নতুবা আটককৃতদের প্রাননাশের হুমকি প্রদান করে।
এসময় আটককৃতরা কাঠ ব্যবসায়ি সমিতিতে রাজি করানোর প্রতিশ্রুতি দিলে সন্ত্রাসীরা তাদের ছেড়ে দেয়।
বনবিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, রাঙামাটির আসামবস্তি এলাকায় অবস্থান করা জেএসএস’র জনৈক কালেক্টর লেলিন চাকমা কর্তৃক বনবিভাগের ডিএফও, এসিএফসহ বিভিন্ন বন কর্মকর্তাকে ফোন করে হুমকি প্রদান করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে বনবিভাগে কর্মরতরা চরম আতঙ্কে রয়েছে বলে জানাগেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএফও পদ মর্যাদার এক বন কর্মকর্তা জানান কাঠ ব্যাবসায়ী সমিতি যদি জেএসএস’র সাথে সমাধান না করে তাহলে বনবিভাগের পক্ষ থেকে কাঠের গাড়ি চেক করতে কোনো লোকবল তারা পাঠাবেন না।
জানাগেছে, রাঙামাটির অন্তত দেড় শতাধিক ব্যবসায়ি সরাসরি কাঠের ব্যবসার সাথে জড়িত। এই ব্যবসায়িদের মাধ্যমেই প্রায় শত কোটি টাকার লেনদেন চলে কাঠের ব্যবসায়। রাঙামাটির অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি এই কাঠের ব্যবসায় অন্তত অর্ধলক্ষাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি-শ্রমিক জড়িত। প্রতিদিন রাঙামাটি থেকে গড়ে ১০ থেকে ১২ ট্রাক কাঠ চট্টগ্রাম-ঢাকায় পাঠানো হয়। এতে করে দৈনিক অর্ধকোটি টাকার লেনদেন হয়।
ছোট-বড় হাজারো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কয়েক লক্ষ্যাধিক পরিবার কাঠের ব্যবসার সাথে জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে কাপ্তাই হ্রদের পানি হু-হু করে কমতে থাকায় কাঠের ব্যবসা অনেকটা সংকুচিত হয়ে আসছে এবং এমতাবস্থায় আঞ্চলিকদলীয় সন্ত্রাসীদের ব্যাপকহারে চাঁদাবাজির ফলে আকস্মিকভাবে কাঠের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছে রাঙামাটির অর্থনীতি।