২০০৮ সালে পথচলা শুরু। তখন থেকেই আইপিএলে খেলে যাচ্ছে পাঞ্জাব কিংস। কিন্তু বলিউড অভিনেত্রী প্রীতি জিনতার মালিকানাধীন ফ্র্যাঞ্চাইজিটি কখনোই চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।
শিরোপার কথা বাদ দিন। আগের ১৭ মৌসুমের মধ্যে ১৫টিতেই প্লে-অফ পর্বে উঠতে ব্যর্থ পাঞ্জাব। সর্বশেষ ১০ আসরে একবারও লিগ পর্বের গণ্ডি টপকাতে পারেনি। ভাগ্য বদলাতে ২০২১ সালে দলের নামও বদলে ফেলা হয়। কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব থেকে নামকরণ করা হয় পাঞ্জাব কিংস। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না।
অবশেষে হয়েছে এবার। ২০১৪ সালের পর প্রথমবারের মতো আইপিএলের প্লে–অফ পর্বে উঠেছে পাঞ্জাব; সেটিও পয়েন্ট তালিকার শীর্ষ দল হিসেবে।
গত নভেম্বরে সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত আইপিএলের মেগা নিলামে সবচেয়ে বেশি অর্থ (১১০ কোটি ৫০ লাখ রুপি) নিয়ে নেমেছিলেন প্রীতি জিনতা। নিলাম শেষে প্রীতি জানিয়েছিলেন, এবারের দল নিয়ে তিনি ৯০% সন্তুষ্ট। এখন নিশ্চয় সন্তুষ্টির মাত্রা আরও বাড়ার কথা তাঁর।
১১ বছর পর পাঞ্জাবের এমন সাফল্য পাওয়ার অন্যতম বড় কারণ দলকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো এবং সব পজিশনে, সব ভূমিকাতেই যোগ্য খেলোয়াড় কেনা। তবে দলটির এভাবে বদলে যাওয়ার পেছনে আরও কয়েকটি ফ্যাক্টর কাজ করেছে। সেগুলো তুলে ধরা হলো—
রিকি পন্টিংকে পাঞ্জাব কিংসের কোচের দায়িত্ব দিয়ে ভুল করেননি প্রীতি জিনতাছবি: বিসিসিআই
পাঞ্জাব কিংস এবার এমন কাউকে প্রধান কোচের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল, ট্রফি জিতে যিনি অভ্যস্ত। এমন অভ্যস্ততা রিকি পন্টিংয়ের চেয়ে খুব বেশি মানুষের নেই।
অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক হিসেবে দুটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও দুটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতেছেন পন্টিং। ২০১৩ সালে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের খেলোয়াড় এবং ২০১৫ সালে দলটির প্রধান কোচ হিসেবে জিতেছেন আইপিএল শিরোপা। সর্বশেষ গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ ক্রিকেটের (এমএলসি) ওয়াশিংটন ফ্রিডমকেও চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছেন। সেই পন্টিংয়ের হাতেই এবার দলের দায়িত্ব সঁপে দিয়েছেন প্রীতি জিনতা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পাঞ্জাবের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই দল গোছানোর পরিকল্পনা শুরু করেন পন্টিং। প্রীতির হাতে ‘প্রজেক্ট পাঞ্জাব’ নামে একটি কর্মপরিকল্পনা তুলে দেন। সে অনুযায়ীই এবার খেলোয়াড় দলে ভেড়ানো হয়।
অধিনায়ক শ্রেয়াস আইয়ারই পাঞ্জাব কিংসের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকছবি: ফেসবুক/পাঞ্জাব কিংস
শ্রেয়াস আইয়ারকে কেন পাঞ্জাব কিংস ২৬ কোটি ৭৫ লাখ রুপিতে কিনেছে, সেটার উত্তর নিশ্চয় পেয়ে গেছেন। ব্যাট হাতে শুরু থেকেই ঝড় তুলতে পারার সামর্থ্য তো বটেই; একজন বড় মাপের অধিনায়ক হওয়ার জন্য যে গুণাবলি থাকা দরকার, সবকিছুই আইয়ারের মধ্যে আছে।
গত বছর আইয়ারের অধিনায়কত্বে আইপিএলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। বছরের শেষ দিকে রাজ্য দল মুম্বাইকে জিতিয়েছেন সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফি। তবে শাহরুখ খানের কলকাতা মেগা নিলামের আগে আইয়ারকে ছেড়ে দেয়। প্রীতির পাঞ্জাব সে সুযোগটাই লুফে নেয়।
পাঞ্জাবের হয়ে নিজের অভিষেক মৌসুমে এখন পর্যন্ত ১৪ ম্যাচে ৫১৪ রান করেছেন আইয়ার, যা দলটির ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ। পাওয়ারপ্লের পর তিনি ১৭৮.০৫ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন, যা এই মৌসুমে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
পাঞ্জাব কিংসেও পন্টিং–আইয়ারের রসায়ন জমে উঠেছেছবি: ফেসবুক/পাঞ্জাব কিংস
আইয়ারকে অধিনায়ক বানিয়ে পাঞ্জাবে নিয়ে আসার পেছনে বড় ভূমিকা পন্টিংয়ের। এর আগে দিল্লি ক্যাপিটালসের কোচ থাকতে আইয়ারকে শিষ্য হিসেবে পেয়েছিলেন পন্টিং। আইয়ারের নেতৃত্বের ভিত তিনিই গড়ে দিয়েছেন। ২০২০ সালে পন্টিং–আইয়ার জুটিই দিল্লি ক্যাপিটালসকে প্রথমবারের মতো আইপিএলের ফাইনালে নিয়ে যায়। এবার পাঞ্জাবে তাঁদের রসায়ন আরও জমে উঠেছে।
পাঞ্জাব কিংসের দুই ওপেনার প্রিয়াংশ আর্য ও প্রভসিমরান সিংয়ের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখনো অভিষেক হয়নিছবি: বিসিসিআই
পাঞ্জাবকে সাফল্য এনে দিতে এবার বড় অবদান রেখেছেন আনক্যাপড (আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখনো যাঁর অভিষেক হয়নি) খেলোয়াড়েরা। দলটির দুই ওপেনার প্রিয়াংশ আর্য ও প্রভসিমরান সিংয়ের জুটি থেকে এসেছে ৪৬৭ রান, যা আইপিএল ইতিহাসে দুই আনক্যাপড ওপেনারের সর্বোচ্চ। কখনোই জাতীয় দলে না খেলাদের মধ্যে নেহাল ওয়াধেরা ও শশাঙ্ক সিংও দারুণ ব্যাটিং করেছেন।
অর্শদীপ সিং ও যুজবেন্দ্র চাহালছবি: বিসিসিআই
টি–টোয়েন্টির অভিজ্ঞ দুই বোলার অর্শদীপ সিং ও যুজবেন্দ্র চাহালের পেছনেও এবার বড় অঙ্কের অর্থ ঢেলেছে পাঞ্জাব। বাঁহাতি পেসার অর্শদীপ ও লেগ স্পিনার চাহালকে পেতে তারা ১৮ কোটি রুপি করে ব্যয় করেছে। দলটির হয়ে আস্থার প্রতিদানও দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
১৮ উইকেট নেওয়া অর্শদীপই এবারের মৌসুমে পাঞ্জাবের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। চাহাল উইকেট নিয়েছেন ১৪টি। চোটের কারণে লিগ পর্বের শেষ দুটি ম্যাচ খেলতে পারেননি চাহাল; নয়তো উইকেটসংখ্যা হয়তো আরও বেশি হতো তাঁর।
পাঞ্জাব কিংসের সবাই সবার জন্য খেলছেনছবি: বিসিসিআই
একটা গল্প দিয়ে উদাহরণ টানা যাক। গল্পটা বলেছেন পাঞ্জাবের মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান শশাঙ্ক সিং। এবারের মৌসুমে পাঞ্জাব কিংস নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলে গুজরাট টাইটানসের বিপক্ষে। ম্যাচটা ১১ রানে জিতেছিল পাঞ্জাব।
অধিনায়ক আইয়ার অপরাজিত ছিলেন ৯৭ রানে। আইয়ার ৯৭ রানে পৌঁছে গিয়েছিলেন পাঞ্জাব ইনিংসের ১৯তম ওভারে। শেষ ওভারে স্ট্রাইক নিয়ে সেঞ্চুরি করার সুযোগ থাকলেও তিনি শশাঙ্ক সিংকেই সব বল খেলার সুযোগ করে দেন।
এ ব্যাপারে শশাঙ্ক বলেছেন, ‘সে আমাকে ২ রান নিয়ে স্ট্রাইকে যাওয়ার তাড়া দিয়েছিল। আমি দুইবার স্কোরকার্ড চেক করেছিলাম—তখন কি সে আসলেই ৯৭ রানে অপরাজিত ছিল! কারণ, ওই সময়ে বেশির ভাগ ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করার জন্য স্ট্রাইক নিতে চাইত। আইপিএলে সেঞ্চুরি করা তো সহজ ব্যাপার নয়।’
শশাঙ্কের কথাতেই স্পষ্ট, খোদ অধিনায়ক এবার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন—পরিস্থিতি যেমনই হোক, আগে দল তারপর অন্য কিছু। এই মৌসুমে পাঞ্জাবের খেলা দেখে থাকলেও মনে হবে, সবাই সবার জন্য খেলছেন।
এই পাঞ্জাব বদলে যাওয়া এক দলছবি: বিসিসিআই
আগে একটা বড় ম্যাচ জিতলেই পার্টি দিতেন প্রীতি জিনতা। এবার তেমনটা হচ্ছে না। পাঞ্জাব তাদের জয়গুলো উপভোগ করছে ঠিকই, কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে ভেসে যাচ্ছে না। এবার লক্ষ্য একটাই—শিরোপা জয়।
কোচ রিকি পন্টিংয়ের কথায় সেই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, ‘আমরা (প্লে–অফে খেলার) যোগ্যতা অর্জন করেছি। হ্যাঁ, এটা একটা বিরাট মাইলফলক ছিল, ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্যও বিরাট অর্জন। কারণ, (সর্বশেষ প্লে–অফে ওঠার পর) অনেক দিন হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা এতে খুশি নই। আমরা এখন পর্যন্ত যা করেছি, তাতেও সন্তুষ্ট নই। মৌসুমের একটা অংশ শেষ হলো মাত্র। এটা আমাদের জন্য কেবল শুরু।’
আজ রাতে আইপিএলের প্রথম কোয়ালিফায়ারে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর মুখোমুখি হবে পাঞ্জাব কিংস। ম্যাচটি জিতলে সরাসরি ফাইনালে উঠে যাবে আইয়ারের দল।