নতুন বছর শুরুতে বই দেয়ার পর থেকে পরিস্থিতির কারণে ক্লাস হয়নি। তাই মেয়েকে ভর্তি করালেও এতোদিন স্কুলে পাঠাতে পারিনি। প্রায় তিন মাস পর মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) স্কুল খুলেছে। আর শিক্ষকেরাও আসছে। তারপর আমিও মেয়েকে নিয়ে স্কুলে আসছি। শিশু শ্রেণিতে মেয়ে এখন পড়ছে। এসব কথা বলছিলেন লালমুনসিয়াম বম (২৬)। সে রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়নের আরথা পাড়ার বাসিন্দা। এ প্রতিবেদক মঙ্গলবার (৪ মার্চ) সরেজমিনে গেল সকাল ১০টায় আরথা পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌঁছান। এসময় বারান্দা দাঁড়িয়ে কথা হয় দুই সন্তানের মা লালমুনসিয়ামের সঙ্গে। তখন তাঁর সাথে আরও বেশ কয়েকজন মা বাচ্চা কোলে নিয়ে বিদ্যালয় বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে শ্রেণি কক্ষের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আরেকজন তিন সন্তানের মা অলিফ বম (২৭) বলেন, তাঁর তিন মেয়ে এ বিদ্যালয়ে পড়ছে। তার মধ্যে চতর্থ ও ৩র্থ শ্রেণিতে পড়ছে। আর সবার ছোট মেয়ে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল।
কিন্তু বই দিয়ে গন্ডগোল শুরু হয়ে গেলে ক্লাসও আর হয়নি। বড় মেয়েকে অন্য কোথাও ভর্তি করাতে চাইছিলাম, তা হয়ে ওঠতে পারিনি। তবে আজকে থেকে ক্লাস করছে, দেখে খুশি লাগছে।
তার মতো শিক্ষার্থী মা সারা বম (২৩) ও ভানরাম বম (৩২)সহ আরও শিশুর মা তাদের সন্তানেরা স্কুলের ক্লাসে দেখে খুব আনন্দবোধ করছেন। তারা বলেছেন ছেলে-মেয়েরা যাতে প্রতিদিন ঠিকমতো শ্রেনি কক্ষে ক্লাস করতে পারে সে পরিবেশ চায় সবসময়।
আরথা পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা বিলকিছ বম বলেন, কবিতা ছড়া ও খেলার মাধ্যমে বাচ্চা শিশুদের শিখানো আমার কাছে খুব ভাল লাগে। এজন্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সবসময় ভাল থাকুক সেটিই চান শিক্ষক বিলকিস বম।
তবে দুর থেকে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে শ্রেণি কক্ষ খোলা দেখা গেলেও বাস্তবে মুননুয়াম পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মঙ্গলবার (৪এপ্রিল) কোনো শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন না। বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে ১১জন শিক্ষার্থি নিয়ে বিদ্যালয় দপ্তরী কাম-নৈশ প্রহরী চাতোয়ান বমকে দেখতে পাওয়া যায়।
এদিকে বাসাত্লাং পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে আজ থেকে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম চলছে বলে প্রধান শিক্ষক তনকুং লুসাই জানিয়েছেন।
আরথা পাড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভানরামলিয়ান বম বলেন, সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ এর সদস্যদের অবাধ বিচরণের কারণে বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তবে সেনাবাহিনী সার্বিক সহযোগিতা নিয়মিত টহলের কারণে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। তাই মঙ্গলবার থেকে যথারীতি পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আশীষ চিরান বলেন, পাইন্দু ইউনিয়নের মুননুয়াম পাড়া, আরথা পাড়া ও বাসাত্লাং পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়মিত পাঠদান শুরু হলেও রেমাক্রীপ্রাংসা ইউনিয়নের দুর্গম কেরসপাই পাড়া, তামলৌ পাড়া, থাইক্ষ্যং পাড়াসহ আরও বেশ কয়েকটি পাড়ার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশেষ পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা জনিত কারণে পাঠদান কার্যক্রম স্থগিত আছে, তার মানে বন্ধ নয়। পরিবেশ পরিস্থিতি ভাল হলে শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে ফিরে যাবে।
তবে দুর্গম পাকনিয়ার পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বন্ধ বলা যায়। সেখানে জানুয়ারী থেকে সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা ওই বিদ্যালয়টি তাদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সদস্যরা এলাকায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণে গত জানুয়ারী মাস থেকে বন্ধ থাকা বান্দরবানের রুমায় পাইন্দু ও রেমাক্রীপ্রাংসা ইউনিয়নে প্রায় ১০টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়।
রুমা জোন কমান্ডার লেঃ কর্ণেল শাহরিয়ার ইকবাল বলেছেন, সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে কেএনএফ সদস্যদের বিতারিত করা হয়েছে। ফলে পাহাড়ে জঙ্গলে থাকা আরথা পাড়া, বাসাত্লাং পাড়া ও মুননোয়ামর সাধারণ লোকজন নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছেন। তাই ওই পাড়ার তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কোনো সমস্যা হবে না। তাছাড়া কেএমএফ বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে সেনাবাহিনীর টহল দল নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হবে বলে জানিয়েছেন সেনা কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য যে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারী পাইন্দু ইউনিয়নের টেবিল পাহাড় এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ এর সশস্ত্র সদস্যরা সেনাবাহিনী টহল দলের উপর সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে উভয় পক্ষের বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা সংঘটিত হয়। এসময় ঘটনা স্থলে গুলিবিদ্ধ হয়ে বেনেট ম্রো নামে কেএনএফ এর সমস্ত্র এক সদস্য মারা যায়।
এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারী রাতে বাসাত্লাং পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেনাবাহিনী উপর গুলি চালায়। এসব ঘটনায় নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। ফলে স্থানীয় ছেলে-মেয়েরা বিদ্যালয় যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে ওই এলাকার বিদ্যালয়গুলো শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় শিক্ষকেরা।