হীম হীম শীত জেঁকে বসেছে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায়। সন্ধ্যার পর থেকে ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায় উপজেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি পল্লীগুলো। আর সেটি অব্যাহত থাকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত। কোন কোন সময় দুপুর পর্যন্ত সূর্যের দেখাও মেলে না। গত কয়েকদিন ধরে এ ঘন কুয়াশা ও শৈত্য প্রবাহে বিরাজ করছে। শীতের তীব্রতায় দুস্থ ও শ্রমজীবি মানুষের জবুথবু অবস্থা। আবার শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাবও। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা।
দরিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীরা প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে রয়েছেন অতিকষ্টে। শীত নিবারণের জন্য দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরতরা খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন বয়োবৃদ্ধ ও শিশুরা। আবার কেউ কেউ গরম কাপড়ের দোকানে দিকে ভিড় জমাচ্ছেন। এদিকে উপজেলায় অর্ধ লক্ষাধিক শীতার্ত মানুষের জন্য সরকারীভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৯২০টি কম্বল। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য।
গত বছর বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৬৬৪টি কম্বল। সোমবার এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, পৌরসভা সহ ত্রাণ, দুর্যোগ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও দু একটি সংস্থা ছাড়া শীতার্তদের সহায়তায় কোন বেসরকারী সংস্থা এগিয়ে আসেনি বলেও জানান স্থানীয়রা। এদের পাশাপাশি দুস্থ ও শ্রমজীবি মানুষ জনের শীতের কষ্ট লাঘবে গরম কাপড় সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সচেতন মহল সহ জনপ্রতিনিধিরা।
সূত্র জানায়, বর্তমানে লামা উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় দুই লাখ। এদের মধ্যে অর্ধ লক্ষ মানুষ মানুষ দারিদ্র ও শীতার্ত। গত মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে উপজেলায় শীতের তীব্রতা শুরু হয়। আস্তে আস্তে এ তীব্রতা বেড়ে চলেছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই পাহাড়ি জনপদে তীব্র শীত জেঁকে বসে। সেই সঙ্গে বাড়ে কুয়াশাও। দুপুর পর্যন্ত শীত ও কুয়াশা অব্যাহত থাকার কারণে নিম্ন আয়ের পাথর শ্রমিকরা কাজে বের হতে পারেন না। এছাড়া বাগান এলাকায় কর্মরত শ্রমিকরাও দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। ঠান্ডা বাতাসের কারণে ছোট ছোট শিশু ও বৃদ্ধরা নিউমোনিয়া ও কাশিসহ ঠান্ডাজনিত রোগে ভুগছে।
শীত নিবারনে এ পর্যন্ত সরকারীভাবে পৌরসভা এলাকার জন্য ৪৯০টি ও প্রতি ইউনিয়নে ৪৯০টি করে ৭টি ইউনিয়নের জন্য ৩ হাজার ৪৩০টি কম্বল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট জানিয়েছেন। অথচ উপজেলায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় দরিদ্র সীমার নিচে বাস করছে বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
এদিকে কুয়াশার কারণে বিশেষ করে রাতের বেলা ও ভোর বেলায় লামা-চকরিয়া সড়কে যান চলাচল ব্যহত হচ্ছে। ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত সড়কে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। জীপ চালক ওসমান গনি শিমুল জানান, দুপুর পর্যন্ত লামা-চকরিয়া সড়কের কয়েকটি এলাকা কুয়াশায় ঢেকে থাকে। অনেক সময় গাড়ির সামনে হেড লাইট জ্বালিয়েও ১৫-১৬ ফুটের বেশি দেখা যায় না। এমন কুয়াশায় এখন গাড়ি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
এখানকার খেটে খাওয়া মানুষগুলো জানান, প্রচন্ড শীতের তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। প্রতিবছর এভাবেই শীতের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। এতে জীবনযাত্রা হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। পাহাড় থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে জ্বালিয়ে আগুনে শরীর ছেঁকে শীত নিবারণের চেষ্টা করেন তারা। ছোট বমু হেডম্যান পাড়ার নারীরা বলেন, আমাদের পাড়ার সবাই গরিব। চাহিদামতো শীতের কাপড় কেনা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সরকারি ভাবে যদি আমাদেরকে কম্বল দিয়ে সহায়তা করা হয় তাহলে ভালো হতো।
পাহাড়ি নারী উমে মারমা বলেন, অন্যবারের চেয়ে এ বছরে বেশি শীত পড়ছে। শীত থেকে রক্ষা পেতে আমরা আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, বেশি শীত পড়লেও আমরা এখানে যারা বসবাস করছি তাদের খবর কেউ রাখে না। আমরা চাই সরকার আমাদের শীতবস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করুক।
পাহাড়ি মংহ্লা চিং মারমা ও জয় মার্মা বলেন, আমাদের গরম কাপড় যা আছে, তা দিয়ে শীত ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। তীব্র শীতের কারণে দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হওয়ায় পরিবার-পরিজনের খাদ্য যোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দুস্থ ও শ্রমজীবী মানুষদের। পাড়ার লোকজন খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করছে।
এ বিষয়ে বাঙালি শ্রমিক আবদুর রহিম ও আবুল হোসেন বলেন, এ বছর অতিরিক্ত শীতের কারণে আমরা কোনও কাজ ঠিকমতো করতে পারছি না। কাজ করতে না পারায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এদিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ফাতেমা পারুল জানান, পরিষদের পক্ষ থেকে একটি পৌরসভা ও ৭ টি ইউনিয়নের শীতার্ত মানুষের মাঝে ১ হাজার ৫০০টি শীতবস্ত্র কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া উপজেলা বিএনপির উদ্যোগে পৌরসভা এলাকায় আড়াইশ ও সরই ইউনিয়নের ১ হাজার দুস্থ মানুষের মাঝে শীত বস্ত্র বিতরণ করে চট্টগ্রামস্থ শেয়ার এন্ড কেয়ার নামক একটি সংস্থা।
সরেজমিন উপজেলা শহরসহ বিভিন্ন বাজারঘুরে দেখা যায়, পুরানো কাপড় নিয়ে ব্যবসায়ীরা পসরা সাজিয়ে বসেছে। খোলা আকাশের নিচে প্রায় অর্ধ-শতাধিক শীতবস্ত্রের দোকান আছে। এসব দোকানে খুচরা মূল্যে পুরানো শীতবস্ত্র কাপড় বিক্রিতে ধুম পড়েছে। বাজারের কাপড় ব্যবসায়ীরা জানায়, গত কয়েকদিন ধরে হাড়ভাঙ্গা শীত পড়ছে। অনুভূত হচ্ছে হিমেল হাওয়া ও ঘন কুয়াশা। গত বছরের চেয়ে এবার পুরনো কাপড় বেচাবিক্রি ভালো হচ্ছে।
লামা সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন জানান, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ মিলে শীত বস্ত্র কম্বল বরাদ্দ পেয়েছি মাত্র ৬৫০পিস। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এখনো অনেক মানুষ শীতার্ত রয়েছে। একই অবস্থা অন্য সব ইউনিয়নগুলোতেও বিরাজ করছে বলে জানান জনপ্রতিনিধিরা।
এদিকে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসক শহীদুল ইসলাম বাবলু বলেন, শীতজনিত কারণে বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা ডায়রিয়া, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হচ্ছে। গত ১ মাসে হাজারেরও বেশি রোগী আন্ত বিভাগে ভর্তিসহ বহি বিভাগে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন।
এ বিষয়ে লামা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, চলতি শীত মৌসুমে উপজেলার একটি পৌরসভা ও সাত ইউনিয়নের দু:স্থ ও গরীবদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ভান্ডার থেকে ৩ হাজার ৯২০টি কম্বল বরাদ্দ দেয়া হয়। ইতিমধ্যে এসব কম্বল শীতার্তদের মাঝে বিতরণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তরও করা হয়েছে।