মুক্তিপণ দিয়ে ১০৪ দিন পর পরিবারের কাছে ফিরেছেন মাদারীপুরের এই তরুণ
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 22-02-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

স্নাতকোত্তর করে কয়েক বছর চাকরির চেষ্টা করেও কিছু হলো না। শেষে কুলপদ্দী বাজারে আমার বাবার মুদিদোকানে সময় দিতে শুরু করলাম। পড়াশোনা করেও জীবনটা এভাবে আটকে যাবে, মেনে নিতে পারতাম না। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো না। বড় ছেলে হিসেবে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখতাম। আমাদের এলাকার অনেকেই বিদেশ থাকে। আমিও ওয়ার্ক পারমিট জোগাড়ের চেষ্টায় নেমে পড়লাম। কোনোভাবেই যখন পারলাম না, তখন আমার এক মামার মাধ্যমে দালাল বোম্বাই রিপনের (সরদার) সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি মরক্কোর ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দিলেন। সে দেশে কিছুদিন থেকে সুযোগ বুঝে ইউরোপের স্পেন বা ইতালিতে পাড়ি জমাতে পারব।

আমার সঙ্গে এলাকার আজাদ হোসেনও যোগ দিল। আমরা দুজন সমবয়সী। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। মামার মাধ্যমে আমরা দুজন দালালের সঙ্গে চুক্তি করলাম। ১৭ লাখ টাকায় স্পেন বা ইতালি পৌঁছে দেবে। কথামতো পাসপোর্টসহ যাবতীয় কাগজ তাঁর লোকজনকে দেওয়া হলো। নগদ অর্থ নিল সাড়ে চার লাখ। দিনকয়েক পর আমাদের যাত্রার তারিখ জানানো হলো।

মিসরের বিমানবন্দরে ২৩ ঘণ্টা

২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর আমাদের যাত্রার দিন। ঢাকায় আমাদের হাতে শ্রীলঙ্কার টিকিট আর কিছু ডলার ধরিয়ে দিয়ে রিপন জানালেন, সব বিমানবন্দরে তাঁর লোকজন আছে। আমাদের কোনো চিন্তা নেই।

 

ঢাকা থেকে প্রথমে ভারতের চেন্নাইয়ে নিল। সেখানে ১৬ ঘণ্টার ট্রানজিট শেষে পরদিন পৌঁছালাম শ্রীলঙ্কা। একদিন শ্রীলঙ্কায় রাখল। তারপর দুবাই হয়ে গেলাম মিসর। এখান থেকে সরাসরি মরক্কো যাওয়ার কথা। মিসরের বিমানবন্দরে আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হলো। ভাবলাম, ভিসা করার জন্য নিয়েছে। সেখানে আমাদের মতো আরও ৪০-৫০ জন বাংলাদেশিকে পেলাম। তাদেরও বিভিন্ন দেশে যাওয়ার কথা। ২৩ ঘণ্টা পর পাসপোর্ট হাতে পেয়েই বুঝতে পারলাম, প্রতারণার শিকার হয়েছি। কারণ, আমাদের লিবিয়ার ভিসা দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই দেশে আমাদের যাওয়ারই কথা না। দালালদের একজন আমাদের কাছে এসে জানাল, চিন্তার কিছু নেই, আমাদের লিবিয়া থেকে আলজেরিয়া হয়ে মরক্কোতে নেওয়া হবে।

বাধ্য হয়ে লিবিয়ার বিমানে চড়ে বসলাম।

গামছা আর লুঙ্গি দিয়ে চোখ, নাক, মুখ বেঁধে উলঙ্গ করে পেটাল একদিন। সেই দৃশ্য ভিডিও করে বাড়িতে পাঠাল। শারীরিকভাবে যত নির্যাতন করা যায়, সবই তারা করতে থাকল। কোনো কোনো দিন মনে হতো বোধ হয় মরেই যাব।

দফায় দফায় বিক্রি

লিবিয়ার বেনগাজিতে দালালের স্থানীয় লোকজন ছিল। তাদের সঙ্গে ত্রিপোলি পৌঁছালাম ১৯ অক্টোবর। তত দিনে আমাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন আরও দুজন। তাঁদের বাড়িও মাদারীপুর। সবাইকে ৫ কি ৬ দিন ত্রিপোলির একটা রুমে রাখল তারা। তারপর একদিন সকালে আমাদের একটা গাড়িতে তোলা হলো। এই গাড়িই আলজেরিয়ার সীমান্তে পৌঁছে দেবে। এক অজানা শঙ্কা নিয়ে চলতে থাকলাম। ৪-৫ ঘণ্টা পর একটা জায়গায় গাড়ি থামল। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে যেতেই কিছু পুলিশ এসে আমাদের ধরল। সবার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিল। কাছাকাছি একটি পুলিশ ফাঁড়িতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। বুঝতে পারলাম, দালাল চক্র আমাদের পুলিশের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। একদিন পর পুলিশের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে মামাকে কল দিলাম। উচ্ছ্বাস নিয়ে তাঁর প্রশ্ন, ‘কেমন আছস, মামা? মরক্কোতে পৌঁছে গেছস?’

 

রাগে-ক্ষোভে তাঁকে গালিগালাজ করতে লাগলাম। বললাম, আমরা পুলিশের কাছে বন্দী। তাঁর সঙ্গে কথা বলা শেষ করে বাড়িতে কল দিয়ে জানলাম, দালাল চক্র জানিয়েছে, আমরা মরক্কো যাচ্ছি তাই মোবাইল সঙ্গে নেই। চুক্তি অনুযায়ী বাদবাকি টাকাও তারা নিয়ে গেছে।

দালাল চক্রের সঙ্গে কথা হলো। তারা জানাল, এক হাজার ডলার দিলে পুলিশ ছেড়ে দেবে। দালাল চক্রকে দেওয়া হলো সেই টাকা। পুলিশ এবার আমাদের লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে তুলে দিল। জেলখানার মতো জায়গায় আমাদের রাখা হলো। রুমে রুমে আমাদের মতো ৬০ জনের বেশি মানুষ। সবাই বাংলাদেশি। পাঁচ দিন সেখানেই কেটে গেল। আমাদের মাধ্যমে পরিবারের কাছে জনপ্রতি ৫ হাজার ডলার মুক্তিপণ দাবি করল তারা। এত টাকা কীভাবে দেবে আমার পরিবার?

আমাদের ওপর নির্যাতন শুরু হলো। গামছা আর লুঙ্গি দিয়ে চোখ, নাক, মুখ বেঁধে উলঙ্গ করে পেটাল একদিন। সেই দৃশ্য ভিডিও করে বাড়িতে পাঠাল। শারীরিকভাবে যত নির্যাতন করা যায়, সবই তারা করতে থাকল। কোনো কোনো দিন মনে হতো বোধ হয় মরেই যাব। এ সময় দুপুরে অল্প একটু নুডলস খেতে দিত। রাতে দিত এক পিস রুটি বা সামান্য নুডলস। এই খেয়ে কি পেট ভরে? খাবারের জন্য কিছু বললে আরও বেশি বেশি মারত।

অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে কয়েক দিন পর তাদের কাছ থেকে মুক্তি পাই। পরে বাড়িতে কথা বলে জানতে পারি, এর মধ্যে আরেকজন দালালের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। জনপ্রতি ৮ লাখ টাকা করে দিয়ে আমাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৮ কি ১৯ নভেম্বর থেকে ফরহাদ নামের সেই দালালের তত্ত্বাবধানেই দিন কাটতে থাকে।

স্থানীয় থানায় জিডি করা হয়। বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আমাদের দেশে ফেরার প্রস্তুতি চলতে থাকে। এর মধ্যেই একদিন ফরহাদ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তওবা কেটে বললাম, আমরা দেশে ফিরতে চাই।

সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে গত ২৬ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসি আমরা।

পরিবার সর্বস্ব হারিয়েছে

পরিবারে আমার মা–বাবাসহ ছোট দুই ভাই ও স্ত্রী। সবাইকে ভালো রাখতেই এই পথে পা বাড়িয়েছিলাম। আমাকে বাঁচাতে আমার পরিবার জমিজমা, সোনাদানা, হালের গরু-ছাগল বিক্রি করে দিয়েছে। বাড়িটাও বন্ধক রেখে সুদে টাকা নিয়েছে। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের থেকেও টাকা ধার নিয়েছে। আমাকে ছাড়িয়ে আনতে ধাপে ধাপে সব মিলিয়ে ৩৩ লাখ টাকা গেছে। এত ধার-দেনা এখন কীভাবে শোধ করব, জানি না।

আপাতত বাবার মুদিদোকানে সময় দিচ্ছি। ওখানে যে আয়রোজগার হয় তা দিয়ে পুরো পরিবারটা চলে না। নতুন করে নিজে কিছু করব, তারও উপায় নেই। পরিবারের জন্য এখন একটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছি। নতুন করে আর কোনো কিছুই ভাবতে পারছি না। স্বপ্নগুলো এখন দুঃস্বপ্নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

শেয়ার করুন