তাঁরা ষাট-সত্তর দশকের বিরাট কোহলি-আনুশকা শর্মা জুটি। ভারতবর্ষে ক্রিকেট ও সিনেমার রোমান্টিক গতিধারায় তাঁরাই সম্ভবত প্রথম কাল্ট জুটি। তাঁদের প্রেম একসময় লোকের মুখে মুখে ফিরত, এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কনটেন্ট, সংবাদমাধ্যমে ফিচার আর মাঝেমধ্যে যদি ‘তিনি’ ক্যামেরায় ধরা দেন, তাহলে হয়তো নতুন কিছু জানা যায়। ‘তাঁরা’ থেকে ‘তিনি’তে নেমে আসায় এখন শুধু তাঁর অপেক্ষাতেই থাকতে হয়।
একসময় অপেক্ষাটা ছিল তাঁদের জন্য। রাস্তায় এই জুটিকে দেখে লোকে শিহরিত হয়েছে। চোখ ফেরাতে পারেনি। এখনো ফেরে না, যখন ফ্ল্যাশব্যাকে নিয়ে যাওয়া ছবি, লেখা কিংবা ভিডিও ক্লিপে ভেসে ওঠে তাঁদের গল্প, এখন যার শেষ অধ্যায়টুকু রুপালি জগতের ‘রানি’কে একাই শেষ করতে হচ্ছে, নিয়তি নবাবকে ছিনিয়ে নিয়ে এই পথটুকুতে তাঁকে একলা ফেলার মোচড় এনেছে। সেই যে ১৪ বছর আগে ‘কাশ্মীর কি কলি’কে ফেলে নবাব যখন চললেন না–ফেরার দেশে।
শর্মিলা ঠাকুর তখন থেকেই একা। নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি যেখানে, তাঁর-ও কি সেখানে একলা লাগে না!
অবশ্য যত গন্ডগোলের মূলে এই একলা লাগাই। মানে প্রেমের শিকড়। ঠিক কবে দুজনের মাথায় সেই শিকড় গজিয়েছিল, সেটা তাঁরা নিজেরাও জানেন না।
রাজযোটকের কেউ যে নিশ্চিত করে বলতে পারেননি, কে প্রথম ভালোবেসেছিলেন।
তবে প্রথম দেখা মনে আছে। ২০০১ সালে জিটিভিতে ‘জিনা ইসি কা নাম হ্যায়’ টক শোতে বলেছিলেন পতৌদি। রসিকতা পছন্দ করতেন মাত্র ২১ বছরে ভারতের অধিনায়ক হওয়া এই নবাব, ‘স্বপ্নে তো আর দেখিনি। প্রথম দেখা চৌষট্টি-পঁয়ষট্টিতে কলকাতায় যখন আমরা খেলতাম।’
রুপালি পর্দায় শর্মিলার ‘অমর প্রেম’ সিনেমার মতোই অমর হয়ে আছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের প্রেমসাবা আলী খানের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল
শর্মিলা তত দিনে সত্যজিৎয়ের ‘অপুর সংসার’ ও ‘দেবী’ থেকে ‘কাশ্মীর কি কলি’ হয়ে ফুটেছেন ভারতীয় সিনেমায়। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, ওই টক শোতে সঞ্চালক ফারুক শেখের কাছে পতৌদির দাবি, দেখা হওয়ার আগে শর্মিলার একটি সিনেমাও নাকি তিনি দেখেননি। এমনকি আরেকটি টক শোতে এ-ও দাবি করেছিলেন, দেখা হওয়ার আগে শর্মিলা ঠাকুর নামটির কোনো আবেদন ছিল না তাঁর কাছে। পতৌদির ভাষায়—‘নাথিং’।
তবে প্রথম দেখা হওয়ার জায়গাটা পতৌদি বলেছিলেন। কলকাতায় খেলার প্রসঙ্গ টেনেই, ‘সম্ভবত কোনো এক বন্ধুর বাসায়।’
সেটা মনে থাকলে নিশ্চয়ই সেদিন কে কোন পোশাকে ছিলেন, তা–ও মনে থাকবে? ফারুক শেখ জানতে ছাড়েননি। শর্মিলা বলেছিলেন, ‘তখন তিনি সাসেক্সে খেলেন। সাসেক্সের সোয়েটার পরেছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে সবে ফিরেছেন। ইংরেজ উচ্চারণ…কৌতুকগুলো বোঝা কঠিন ছিল। নিজে বলে নিজেই হাসতেন।’
পতৌদি স্মরণ করেন, শাড়ি পরে এসেছিলেন শর্মিলা।
প্রেমে প্রথম দেখা হওয়ার আগেও একটি ভিত থাকতে পারে। তাঁদের ছিল। সেটা বলিউডে শর্মিলারই সমসাময়িক অভিনেত্রী সিমি গারওয়ালের টক শোতে বলেছেন দুজন। সিমি দুজনকে ভালো জানেনও। বিশেষ করে নবাবকে। ‘রঁদেভু উইথ সিমি গারেওয়াল’ টক শোয়ে নবাবের সঙ্গে রানিও গিয়েছিলেন। দুজনের নম্র ও বিনয়ী সব উত্তর শুনে সিমি একপর্যায়ে হাসতে হাসতে বলেই ফেলেন, ‘তোমরা কত ভদ্র ও শিষ্টতার সঙ্গে সব বলছ। একসময় কেমন ছিলে, সেটা তো আমি জানি।’
রাজযোটক—মনসুর আলী খান পতৌদি ও শর্মিলা ঠাকুরসাবা আলী খানের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল
শর্মিলাকে দেখার আগে সিমির প্রেমে মজেছিলেন নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি।
বেশ গাঢ় ছিল সেই প্রেম। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় ২০১১ সালে সিমির টক শোর রেফারেন্স টেনে নবাবের সঙ্গে তাঁর প্রেম ও ভাঙন নিয়ে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, দুজনের বিয়ের দিন-তারিখ ঘোষণা শোনার অপেক্ষায় ছিল ভারতের ক্রিকেট-সমাজ। কিন্তু সত্যজিৎয়ের ‘দেবী’ শর্মিলাকে দেখার পর নবাব আর সিমির পথে পা বাড়াননি।
আলুথালু চোখে একদিন সন্ধ্যায় সিমির বাসায় গিয়ে সম্পর্ক চুকেবুকে দিতে নবাব বলে দেন, তাঁর ‘অন্য কাউকে দেখে’ ভালো লেগেছে। সিমি নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে তাঁকে অনেকটা জোর করেই লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখেন সেই ‘অন্য কেউ’কে—লিফটের পাশেই দাঁড়িয়ে শর্মিলা!
পতৌদি ভারতীয় ক্রিকেটে ‘টাইগার’ নামের কিংবদন্তি। অনেক বছর পর সেই সিমির টক শোতেই বাঘের মতো সাহস নিয়ে শর্মিলার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ হলো, সেটা বলেন পতৌদি, ‘এক দম্পতি বসবাস করতেন সেখানে (জায়গার নাম বলেননি)। সে (শর্মিলা) ওখানে ছিল। আমি তাকে ফোন করি। (ফোন) নম্বর কোত্থেকে যেন পেয়েছিলাম। তাকে বলি, ইংল্যান্ড থেকে তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।’ পতৌদি এটুকু বলার পর সিমি তাঁকে থামিয়ে জানতে চান, ‘সত্যিই কি কিছু এনেছিলে?’ পতৌদির নির্বিকার উত্তর—‘না।’
মজার সেই কথোপকথনের এই জায়গায় এসে শর্মিলা বাকিটুকু বলেন, ‘সে আসলে (ফোনে) আমার জন্য একটি বার্তা রেখে গিয়েছিল। পাঁচটি ফ্রিজ এনেছে আমার জন্য। খুব কৌতূহল জেগেছিল আমার।’ পতৌদি যোগ করেন, ‘এরপর সে আমাকে ফোন করে...এভাবে আমাদের দেখা হয়।’
তরুণ নবাব মনসুর আলী খান পতৌদিসাবা আলী খানের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল
ফ্রিজের সেই ঘটনাটি নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে অনেক লেখালেখি হয়েছে। ফিল্মফেয়ার ওয়েবসাইটকে ২০২১ সালে এটা নিয়ে বলেছিলেন শর্মিলা–পতৌদির কন্যা ও বলিউড অভিনেত্রী সোহা আলী খান, ‘আব্বার সঙ্গে আম্মার সিনেমার এক পার্টিতে দেখা হয়েছিল। আব্বা আম্মাকে পছন্দ করতেন। আম্মা খুব সুন্দরী ছিলেন, এখনো তাই। তিনি আম্মার পেছনে ঘুরেছেন, তবে আম্মা পাত্তা দিচ্ছিলেন না। আম্মার প্রতিক্রিয়া জানতে আব্বা এরপর ৭টি ফ্রিজ পাঠান বাসায়। আম্মা এরপর ফোন করে আব্বার কাছে জানতে চান—ঘটনা কী? এভাবেই (সম্পর্ক) শুরু হলো।’
তবে ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ জানিয়েছে, অমিতাভ বচ্চনের ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ রিয়েলিটি শোয়ের ১৫তম সিজনে ফ্রিজের ঘটনাটি জানিয়েছিলেন শর্মিলা। তাঁর ভাষায় সেটার শুরু এভাবে, ‘কলকাতায় ক্রিকেটের এক পার্টিতে দেখা হওয়ার পর ফোন নম্বর বিনিময় হয়। “ওয়াক্ত” সিনেমার শুটিংয়ের জন্য আমরা নৈনিতালে যাচ্ছিলাম। তখন দিল্লিতে সে ডাবল সেঞ্চুরি পায় এবং তাকে ফোন করে বাসায় পাইনি। ডাবল সেঞ্চুরির জন্য তাকে অভিনন্দনসূচক বার্তা জানিয়ে ফোন রেখে দিই।’
শর্মিলা এরপর জানিয়েছেন ফ্রিজ উপহারের সেই ঘটনা। কয়েক মাস মুম্বাইয়ে থাকতে শর্মিলার কাছে একটি ফোন আসে। অপর প্রান্ত থেকে তাঁকে বলা হয়, লন্ডন থেকে আসা পাঁচটি ফ্রিজ তিনি গ্রহণ করেছেন। তখন আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় শর্মিলা একটু ভড়কেই গিয়েছিলেন। ফোনের ওই প্রান্ত থেকে একটি নম্বরও দেওয়া হয় তাঁকে। শর্মিলা সেই নম্বরে ফোন দিয়ে বুঝতে পারেন, এই কাজটি করেছেন পতৌদি এবং তিনি স্বীকারও করেন স্রেফ মজা করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। শর্মিলা এটুকু বলে শেষ করেছেন এভাবে, ‘তো এভাবেই ঘটনার শুরু। সে জানতে চাইল, কফি খেতে যেতে পারব কি না? বললাম, হ্যাঁ যাওয়া যায়।’
বলিউড অভিনেত্রী রাখির বিয়ের মেহেদী অনুষ্ঠানে মনসুর আলী পতৌদি ও শর্মিলা ঠাকুরসাবা আলী খানের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল
শর্মিলা ও পতৌদির কাছে ফারুক শেখ ও সিমি গারেওয়াল নিজ নিজ টক শোতে জানতে চেয়েছিলেন, প্রেম হওয়ার পর বাইরে তাঁরা কেমন দেখাসাক্ষাৎ করেছেন, মানে ডেটিংয়ে গেছেন কেমন? দুজনই জানান, খুব কমই যাওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ সময় তাঁরা দেখা করেছেন বন্ধুর বাসায়। বাইরে ঘুরতে বের হলে লোকে জেঁকে ধরত। শর্মিলার ভাষায়, ‘একবার তো দুজন মেট্রোতে সিনেমা দেখে বের হয়ে “মব”–এর শিকার হয়েছিলাম। কানের দুল হারিয়ে ফেলেছিলাম।’
ব্যাপারটি মোটেও অস্বাভাবিক না। সেই সময় পতৌদি–শর্মিলা জুটির আবেদনই অন্য রকম ছিল। মনসুর আলী খান পতৌদি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই নবাব। তাঁর বাবা ইফতিখার আলী খান ছিলেন দিল্লির অধিভুক্ত পতৌদি রাজ্যের নবাব। শুধু তা–ই নয়, ভারত ও ইংল্যান্ডের হয়েও টেস্ট খেলেছেন ইফতিখার, ছিলেন ভারতের অধিনায়কও। তাঁর ছেলে মনসুর অনেকের চোখেই ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অধিনায়ক, যে দায়িত্ব তিনি পেয়েছিলেন ২১ বছর বয়সে। এক দুর্ঘটনায় এক চোখ নষ্ট হওয়ার প্রায় ছয় মাস পর ভারতের হয়ে তাঁর টেস্ট অভিষেক। লেখাপড়া আলিগড়, দেরাদুন ও ইংল্যান্ডের স্কুলে। অক্সফোর্ড ব্লু এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের অধিনায়কও ছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ব্যাল্লিওল কলেজে শিখেছেন আরবি ও ফরাসি ভাষা। ইংল্যান্ডের স্কুলে পড়াকালীন দ্বৈত জুটিতে পাবলিক স্কুল র্যাকেটস চ্যাম্পিয়নশিপও জিতেছেন। ৬ ফুট লম্বা সুঠাম দেহের সানগ্লাস পরা পতৌদি তখন ভারতের অনেক নারীর ‘ক্রাশ’ ছিলেন। তবে শর্মিলার পছন্দের ক্রিকেটার কিন্তু ছিলেন আরেকজন—এম এল জয়সীমা।
মানুষের ভিড়ে সবসময়ই মধ্যমণি হয়ে থাকতেন শর্মিলা ও মনসুরসাবা আলী খানের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল
জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির রক্ত শর্মিলার শরীরে। সত্যজিৎয়ের ‘অপুর সংসার’ ও ‘দেবী’ সিনেমা করে চলে আসেন পাদপ্রদীপের আলোয়। ১৯৬৪ সালে শক্তি সামন্তের ‘কাশ্মীর কি কলি’ সিনেমা দিয়ে বলিউডে অভিষেকের পর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি দুবার জাতীয় পুরস্কারজয়ী এই অভিনেত্রীকে। সৌন্দর্য, অভিনয়শৈলী, সাহস ও গ্ল্যামারের মিশেলে ভারতীয় সিনেমায় অন্য রকম এক মাধুর্য এনেছিলেন তিনি। জানিয়ে রাখা ভালো, ভারতীয় সিনেমায় প্রথম বিকিনি পরে শট দেওয়া (অ্যান ইভিনিং ইন প্যারিস) অভিনেত্রীও কিন্তু শর্মিলা।
সে যাহোক, প্রেম করতে করতেই একদিন শর্মিলাকে নিয়ে তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করেন পতৌদি। সিমির অনুষ্ঠানে শর্মিলা বলেছেন সেই ঘটনা। তাঁর মাকে পতৌদি সরাসরি বলেন, ‘রিংকু (শর্মিলার ডাকনাম) এবং আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ শর্মিলা জানিয়েছেন, মাকে এই কথা বলার আগে পতৌদি তাঁকে এ নিয়ে কিছুই বলেননি। এ নিয়ে তখন একটু পারিবারিক জটিলতাও তৈরি হয়েছিল। তবে দুজনের বল্গাহীন প্রেমের সামনে কোনো জটিলতাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
কন্যা সোহা আলী খানের সঙ্গে শর্মিলা ঠাকুর। এখন যেমন আছেন তিনি। মাঝের ছবিটি শর্মিলার ‘দেবী’ সিনেমারসোহা আলী খানের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল
প্যারিসে ‘বাস্তিল ডে’–তে শর্মিলার সঙ্গে একটি পার্কে হাঁটতে হাঁটতে পতৌদি হঠাৎ করেই হাঁটু মুড়ে বসে বিয়ে করার ‘প্রপোজ’ করেছিলেন তাঁকে। এরপর শর্মিলা ধর্ম পাল্টে পতৌদিকে বিয়ে করলেন ১৯৬৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর। বেগম আয়েশা সুলতানা তাঁর নতুন নাম হলেও বিশ্ব তাঁকে সত্যজিৎয়ের ‘দেবী’ ও শর্মিলা নামেই চেনে ও জানে। তবে পতৌদি তাঁকে রিংকু নামেও ডাকতেন। ২০১১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে শর্মিলা তাঁর সেই ডাকটা শোনেন না। সেদিন মারা যান বাবার মৃত্যুতে মাত্র ১১ বছর বয়সে নবাবি পেয়ে যাওয়া মনসুর আলী খান পতৌদি। ক্রিকেটার পরিচয়েই অবশ্য বিশ্ব তাঁকে বেশি চেনে, জানে এবং সম্মান করে।
কিন্তু শর্মিলার কাছে? শুধু স্বামী নন, চিরকালীন এক প্রেমিকও।