নারী শিল্পীরাই কেন লক্ষ্যবস্তু
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 31-01-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে একটি রেস্তোরাঁ উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল, তবে একদল জনতার বাধার মুখে শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস।

তিন মাসের ব্যবধানে একই কায়দায় চট্টগ্রামে মেহজাবীন চৌধুরী, টাঙ্গাইলে পরীমনি বাধার মুখে পড়েছেন।

প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে একই রকম ছক, নায়িকা আসার খবরে বাদ সাধছেন একদল লোক, পরে ঠেকানোর ঘোষণা দিচ্ছেন। বাধ্য হয়ে শিল্পীদের বাদ দিচ্ছেন আয়োজকেরা। থানা-পুলিশেও খুব একটা সুরাহা মিলছে না।

টাঙ্গাইলে বাধার মুখে পড়েছেন পরীমনি

টাঙ্গাইলে বাধার মুখে পড়েছেন পরীমনিফেসবুক থেকে

বিষয়টি নিয়ে অপু বিশ্বাস ও মেহজাবীন চৌধুরী সরাসরি কোনো কথা না বললেও পরীমনি চুপ থাকেননি।

২৫ জানুয়ারি এক ফেসবুক পোস্টে এই অভিনেত্রী লিখেছেন, ‘এত চুপ করে থাকা যায় নাকি। পরাধীন মনে হচ্ছে। শিল্পীদের এত বাধা কেন আসবে? ইনসিকিউর ফিল (অনিরাপদ বোধ) হচ্ছে। এমন স্বাধীন দেশে নিরাপদ নই কেন আমরা?’ মেহজাবীনের ঘটনার উদাহরণ তুলে পরীমনি লিখেছেন, ‘ধর্মের দোহাই দিয়ে কী প্রমাণ করতে চলেছেন তাঁরা? কী বলার আছে আর। এ দেশে সিনেমা, বিনোদন সব বন্ধ করে দেওয়া হোক তাহলে।...এই দায়ভার কিন্তু আমাদের সবার নিতে হবে।’

চট্টগ্রামে বাধার মুখে পড়েছেন মেহজাবীন চৌধুরী

চট্টগ্রামে বাধার মুখে পড়েছেন মেহজাবীন চৌধুরীফেসবুক থেকে

 

 

কী ঘটছে

কামরাঙ্গীরচরের খোলামোড়া ঘাটের সেই রেস্তোরাঁ অপু বিশ্বাসের উদ্বোধন করার কথা ছিল গত মঙ্গলবার। এ নিয়ে কী ঘটেছিল? রেস্তোরাঁটির অন্যতম কর্ণধার সৈকত খান গতকাল প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা ফেসবুকে অপু বিশ্বাসের আসার ঘোষণা দেওয়ার পর কয়েকজন কামরাঙ্গীরচর থানায় যান, তাঁরা অপু বিশ্বাসকে নিয়ে আপত্তির কথা জানান।

তবে কে বা কারা অভিযোগ করেছেন, জানতে চাইলে সৈকত খান বলেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। বিষয়টি নিয়ে বুধবার কামরাঙ্গীরচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমীরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘...ফেসবুকে হুজুররা প্রতিবাদ জানান। তাঁরা বলেছিলেন, অপু বিশ্বাসকে উদ্বোধনে আনা হলে বিশৃঙ্খলা করবেন। আমি ফেসবুকে লেখালেখির স্ক্রিনশটও পেয়েছি। বিষয়টা ডিসি স্যারের কাছেও জানানো হয়। আমার কাছে রেস্টুরেন্টমালিকেরাও আসেন। তাঁরা জানান, অপু বিশ্বাসকে আনলে যদি হুজুররা বিশৃঙ্খলা করেন, আপত্তি জানান, তাহলে আমরা অপু বিশ্বাসকে আনব না। আমরা ব্যবসা করব। লোকজন নিয়ে চলতে হবে। কারও সঙ্গে আমাদের বিরোধের দরকার নেই।’

 

ডিপফেকের শিকার ঢাকার অভিনেত্রীও! এসব ভুয়া ভিডিও চিনবেন কীভাবে

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে একদল জনতার বাধার মুখে রেস্তোরাঁ উদ্বোধনে যেতে পারেননি চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে একদল জনতার বাধার মুখে রেস্তোরাঁ উদ্বোধনে যেতে পারেননি চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাসফেসবুক থেকে

সৈকত খান বলেন, পরে অপু বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে উদ্বোধন করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিরও যোগসাজশ থাকে।’

 

তিনি (শিল্পী) একটা প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন, সেখানে তাঁকে আটকানোর কারণ কী? তিনি কি ঋণখেলাপি, তিনি কি টাকা চুরি করে পাচার করেছেন? তা তো নয়। তিনি একজন শিল্পী। শিল্পীকে তাঁর মর্যাদা দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা

সামিনা লুৎফা

সামিনা লুৎফা

নারী শিল্পীরাই কেন লক্ষ্যবস্তু
তিন মাসের এমন ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত কোনো পুরুষ তারকাকে বাধা দেওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসেনি। মূলত নারী তারকাদের বাধা দেওয়া হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটাও দেখেছেন, নারী ফুটবলারদের ফুটবল খেলতে দেওয়া হচ্ছে না। নারী তারকাদের বাধা দেওয়ার ধরনটা একই রকম। নারীকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আরও অনেকভাবেই একধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যেটা বাংলাদেশের জনগণ মেনে নেবে না, নেয়ওনি। কোনোটাই আসলে সফল হবে না বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ বহু সামাজিক বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে চলে। এখানে একদল মানুষ বললেই বা একধরনের ভায়োলেন্স (সহিংসতা) কায়েম করলেই মেনে নেবে, ব্যাপারটা এমন নয়।’

ওরা স্বাধীনচেতা নারী ও আধুনিক সমাজকে খুবই ভয় পায়। সেটাকে দমিয়ে রাখতে চায়।

নির্মাতা আশফাক নিপুন

আশফাক নিপুন

আশফাক নিপুননির্মাতার ফেসবুক থেকে

নির্মাতা আশফাক নিপুন বলেন, ‘এই রাজনীতি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এই রাজনীতি কোনো সফল নারীকে বাধা দেওয়ার রাজনীতি। একধরনের ইনসিকিউরিটি (নিরাপত্তাহীনতা) থেকে ধর্মপন্থী কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী এগুলো করছে। ওরা স্বাধীনচেতা নারী ও আধুনিক সমাজকে খুবই ভয় পায়। সেটাকে দমিয়ে রাখতে চায়।’

থিয়েটার–কর্মী সামিনা লুৎফা বলেন, ‘একজন শিল্পী নারী কি পুরুষ, তার চেয়ে বড় কথা তিনি শিল্পী। তিনি একটা প্রতিষ্ঠান উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন, সেখানে তাঁকে আটকানোর কারণ কী? তিনি কি ঋণখেলাপি, তিনি কি টাকা চুরি করে পাচার করেছেন? তা তো নয়। তিনি একজন শিল্পী। শিল্পীকে তাঁর মর্যাদা দিতে হবে।’

নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন অভিনয় শিল্পী সংঘও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। আজ সংগঠনটির সাধারণ সভায় বিষয়টি তোলা হবে। আজই সম্মিলিতভাবে শিল্পীদের তরফ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হবে।

প্রতিহত করতে হবে

আশফাক নিপুনের ভাষ্যে, ‘স্বৈরশাসককে ফেলার পর সবাই ভাবছে, সবাই স্বাধীন। স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে যে আসলে একটা পার্থক্য আছে, সেই জিনিসটা অনেকে বুঝতে পারছে না। ওরা যেটা করছে, সেটা স্বেচ্ছাচারিতা।’

এসবের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা প্রশ্রয় পাচ্ছে বলে মনে করেন সামিনা লুৎফা। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র বা সরকার যেহেতু যথেষ্ট শক্ত ভূমিকা নিচ্ছে না বা লোকে দেখতে পাচ্ছে না, তাই এরা একধরনের প্রশ্রয় পাচ্ছে। প্রশ্রয়টা যেন তারা না পায়, এটা দেখা খুবই জরুরি। নারী শিল্পীদের যেভাবে ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে একটি বিশেষ মহল থেকে, সেটা প্রতিহত করতে হবে। এটা সরকারের দায়িত্ব।’

রাষ্ট্রের পাশাপাশি সামাজিকভাবেও তাদের প্রতিহত করার জরুরি বলে মনে করেন নির্মাতা নিপুন। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার হোক বা নির্বাচিত সরকারই হোক, তাদের মাথায় রাখতে হবে, যেকোনো ক্ষেত্রে এ ধরনের মব (উন্মত্ত জনতা) প্রতিহত করা দরকার। নারীদের নিরাপত্তা দিতে হবে। সামাজিকভাবে আমাদের দায়িত্ব হলো, এসবে ভয় না পেয়ে প্রতিহত করতে হবে।’

নাটকের অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন অভিনয় শিল্পী সংঘও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। আজ সংগঠনটির সাধারণ সভায় বিষয়টি তোলা হবে। আজই সম্মিলিতভাবে শিল্পীদের তরফ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিনয় শিল্পী সংঘের এক জ্যেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কোথাও কোথাও শুটিং ইউনিটকে বাধাও দেওয়া হচ্ছে। এগুলো আমাদের শঙ্কিত করছে। আমরা আগামীকাল (আজ) বিবৃতি দেব।’

 

পরামর্শক কমিটি কতটা কার্যকর হবে

 

শেয়ার করুন