প্রায়ই আমরা কায়াক অভিযানে বের হই। বেশ কিছুদিন ধরে পরিকল্পনা করেছিলাম ব্রহ্মপুত্রের প্রবেশমুখ থেকে কায়াক চালিয়ে কয়েক ধাপে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে যাব। সেই লক্ষ্যেই ২০ ফেব্রুয়ারি ভারত সীমান্তঘেঁষা কুড়িগ্রামের ঝুনকার চরে যাওয়া। এবার আমার সঙ্গী নওশাদ নওয়াজ। ইনফ্ল্যাটেবল কায়াকটা আমরা দুজনে চালাব। চরে তারই অল্প পরিচিত একজনের বাড়িতে রাতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়।
ঝুনকার চরের পাশ দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ব্রহ্মপুত্র। সেখানে নদীতে নেমে মনটা প্রশান্ত হয়ে গেল। অনেক দিন দীর্ঘ সাঁতার না-কাটা শরীরও চনমন করে উঠল। মনে হচ্ছিল কায়াক রেখে সাঁতরাই। নওশাদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললাম। কায়াক সে একাই চালাবে। আমি পাশে পাশে সাঁতরাব।
২১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে আটটায় শুরু হলো আমাদের জলযাত্রা। ব্রহ্মপুত্রের নীলাভ জলে কায়াক নিয়ে এগোতে থাকল নওশাদ, আমি চললাম সাঁতার কেটে। দুই ঘণ্টা যাওয়ার পর একটা ঘাট দেখে বিরতি নিলাম। এতক্ষণে প্রায় ৮ কিলোমিটার সাঁতার কাটা হয়ে গেছে। ঘাটের পাশেই কয়েকটা দোকান। একটা দোকানে নদীর ছোট মাছের তরকারি দিয়ে খেয়ে নিলাম।
পদ্মা নদীতে সাঁতার কাটছেন মুহম্মদ রফিকুল ইসলামছবি: মুহম্মদ রফিকুল ইসলামের সৌজন্যে
দিনে কতটা পথ পেরোব তার একটা ধারণা থাকলেও ঠিক কোথায় থামব, কোথায় থাকব, তা ঠিক ছিল না। দিনের আলো নিভে আসার আগেই সুবিধামতো কোনো স্থান খুঁজে নিয়ে তাঁবু খাটিয়ে থাকাই ছিল আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা। সেদিন আরও ১৩ কিলোমিটার সাঁতরে উলিপুরের গুজিমারি চরে বিরতি নিলাম। তখন বিকেল। নদীপাড়ে কায়াক গোছগাছ করতে দেখে আমাদের ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড় জমে গেল। কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাব, সত্যি কি এতটা পথ সাঁতরে এসেছি, কোনো ভয় করেনি—এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে স্থানীয় চেয়ারম্যানের খোঁজ করছিলাম। কোথাও থাকার ব্যবস্থা করাই ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু তাঁকে না পেয়ে তাঁবু খাটানোর কথা ভাবছি। ঠিক তখনই এক নারী তাঁর স্বামীকে ডেকে বললেন, ‘তাদের বাড়িতে নিয়ে চলো।’ ঘাটের ওপার থেকে আসা ওই নারী অন্য কৌতূহলীদের মতোই আমাদের কাছে এসে সব শুনছিলেন।
চরের এই দম্পতি থাকার ঘরটাই আমাদের জন্য ছেড়ে দিলেন, সংগ্রহের সবচেয়ে ভালো চাদরটাই দিলেন বিছানায় পেতে, খাবার আসনে বিছিয়ে দিলেন ধুয়ে রাখা গামছা! বিবিধ আপ্যায়নে প্রথম রাতটা সেই বাড়িতেই কাটল।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ওশানম্যান প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন মুহম্মদ রফিকুল ইসলামছবি: মুহম্মদ রফিকুল ইসলামের সৌজন্যে
নদীপাড়ের মানুষের নিবিড় আপ্যায়ন ও রাতের বিশ্রাম শেষে পরদিন আবার নেমে পড়লাম শান্ত-স্নিগ্ধ পানিতে। চারপাশে চরের ধবধবে বালু উজ্জ্বল দীপ্তি নিয়ে জ্বলছে। এসবের পাশ দিয়ে সাঁতরে যেতে যেতে শুনতে থাকলাম জলের কল্লোল। এভাবে ১৫ কিলোমিটার সাঁতার কেটে সেদিন পৌঁছে যাই চিলমারীর বন্দরে। দুই দিনের অভিযান শেষে ঢাকায় ফিরে আসি।
তিন দিন ধরে পরিকল্পনা করে আবার ফিরে যাই চিলমারী। সাঁতারের আরও কিছু সরঞ্জাম সঙ্গে নিই। আমার সঙ্গে এবার যুক্ত হলো অভিযানপ্রিয় সংগঠন ‘অভিযাত্রী’র একদল স্বেচ্ছাসেবক। শুরু হলো ‘দ্য গ্রেট ডেলটা সুইম’।
চিলমারী থেকে কায়াক নিয়ে সাঁতারে আমার সঙ্গী হয় চিকিৎসক সাফকাত ফারুক। নদীতে আমার আনন্দ-সাঁতারে আরও যোগ দেয় কতিপয় শুশুক। আমরা একে একে পেরিয়ে আসি কত কত গ্রাম, জনপদ, গঞ্জ, বন্দর—চর কাপাসিয়া, বালাসিঘাট, মুন্সিরহাট, সারিয়াকান্দি, সিরাজগঞ্জ। কোথাও কমে আসে নদীর জল, কোথাও আবার ছুঁয়ে যায় দিগন্ত, কোথাও চরের মিহিন বালুতে লেগে যায় আমার পা, কোথাওবা গহিন গভীর জলস্রোতে থই পাওয়া যায় না।
তিন দিন বিরতি দিয়ে ১৩ মার্চ যমুনা সেতু পেরোনোর পর থেকে ক্রমেই প্রশস্ত হতে থাকে নদী, সমানতালে বাড়তে থাকে গভীরতা। শুধু কায়াক ভরসা করে দীর্ঘ পথ সাঁতরানো কঠিন হয়ে ওঠে। তাই আমরা সঙ্গে একটা বড় নৌকা নিয়ে নিই। এতে যথাযথ খাবার আর উপযুক্ত বিশ্রামের সুযোগ হয়। আমি সাঁতরে চলি কূলকিনারাহীন নীল যমুনার জলে।
এক নদী থেকে অন্য নদী হয়ে এভাবেই সাঁতার কেটে বঙ্গোপসাগরের দিকে ছুটে যাচ্ছেনছবি: অভিযাত্রী
চৈত্রের সকাল, দুপুর ও পড়ন্ত বেলায় যমুনার শীতল জলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে পেরিয়ে আসি বারবেলা চর, কালিগঙ্গা নদীর উৎসমুখ। আর তারপরেই গিয়ে পড়ি উত্তাল ঢেউয়ের মুখে, পদ্মা-যমুনার মিলনস্থল দৌলতদিয়ায়। সেদিন আকাশজুড়ে কালো মেঘ, দিগন্তে দিগন্তে জেগে ওঠে বজ্রবিদ্যুৎ, শুরু হয় এলোমেলো দমকা হাওয়া। প্রমত্ত পদ্মা উন্মত্ত হয়ে ওঠে। আমাদের ট্রলার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়, কিন্তু উথালপাতাল ঢেউয়ে চলতে থাকে আমার নির্বোধ সন্তরণ। বাহাদুরপুর ঘাট, দোহার, মাওয়া, সুরেশ্বর হয়ে পৌঁছে যাই চাঁদপুর তিন নদীর মোহনায়। ২২ মার্চ, সাঁতারের ১৯তম দিনে পূর্ণ হয় ‘দ্য গ্রেট ডেলটা সুইম’-এর ৪০০ কিলোমিটার।
তিন দিন বিরতির পর স্বাধীনতা দিবসে চাঁদপুর থেকে আবার শুরু করি সাঁতার। মেঘনার বিস্তৃত মোহনা ও উত্তাল ঢেউ দেখে মনে হয় যেন সমুদ্র। জলও বেশ ভারী আর লোনা। এদিন মাত্র ১১ কিলোমিটার সাঁতার কেটে মেঘনা নদীর মাঝামাঝি গাজীপুর কুতুবপুর-মুলাবারিতে বিরতি নিতে হয়।
প্রথম দিকে সঙ্গে যখন নৌকা ছিল না, তখন সকালে দুই-তিন ঘণ্টা সাঁতরে ঘণ্টাখানেক বিরতি নিয়েছি, তারপর আরও ঘণ্টা দুয়েক সাঁতার কেটে দুপুরে দ্বিতীয় বিরতির পর বিকেলে এক-দেড় ঘণ্টা সাঁতার কেটেছি। কিন্তু জোয়ার-ভাটার মেঘনায় এসে এই নিয়ম আর মানতে পারছি না। এখানে ভাটার সময় ধরে সাঁতরাতে হয়। তাই সকালে তিন-চার ঘণ্টার পর বিকেলে ঘণ্টাখানেক সাঁতারের সুযোগ পাওয়া যেত। আর জোয়ারে সমুদ্রের দিকে সাঁতরানো যে কী কঠিন কাজ, বলে বোঝানো যাবে না। এমনি এক সময়ে টানা দেড় ঘণ্টা সাঁতরেও এক মিটার সামনে এগোতে পারিনি, বরং পিছিয়ে গেছি ৫০০ মিটার!
জোয়ার-ভাটার হিসাব কষেই ২৭ মার্চ বরিশালের হিজলার কাছাকাছি এক ডুবোচরে বিরতি দিয়ে রাতে কাকুরিয়া বাজারে থাকি। ২৮ মার্চ ভোলার ইলিশায় বিরতি দিয়ে পরদিন সাঁতার শুরু করতেই মুখে লাগল লোনা জলের স্বাদ। ২৯ মার্চ ভোলার তজুমদ্দিনের আগে চৌমুহনীতে গিয়ে দিনের বিরতি। ৩০ মার্চ ২১ কিলোমিটার সাঁতার কেটে হাতিয়া চ্যানেল হয়ে সোনাদিয়ায় বিরতি নিয়ে পরদিন শুভ সমাপ্তির অপেক্ষা।
সাঁতার–অভিযান শেষে জাতীয় পতাকা হাতে মুহম্মদ রফিকুল ইসলামছবি: অভিযাত্রী
৩১ মার্চ সোনাদিয়া থেকে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছি। ভাটার প্রচণ্ড টানে তীব্র বেগে সাঁতরে চলছি। কোনোভাবেই কায়াক আর আমি একসঙ্গে থাকতে পারছি না। হয় কায়াক ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যায় অনেক দূর, নাহয় আমি অনেকটা এগিয়ে যাই। পাশে থাকা নৌকাও টাল সামলাতে ব্যস্ত। এরই মধ্যে ২০০-৩০০ ফুট পরপর মৃত্যুফাঁদের মতো একেকটা বেহুন্দি জাল। ভাটার প্রচণ্ড টানে তীব্র বেগে সবকিছু গিয়ে বেহুন্দি জালের গহ্বরে পড়ছে। একবার সে জালে আটকালে ভাটার টান উজিয়ে বের হওয়া যেন অসম্ভব এক কাজ। বেশ কয়েকবার জালে আটকা পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম কপালগুণে!
অবশেষে জোয়ার-ভাটার সমীকরণ মিলিয়ে, বেহুন্দি জাল এড়িয়ে, মোহনার উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিণে এসে পৌঁছাই। ওই তো দেখা যায় নিঝুম দ্বীপের শ্যামল ছায়া—আমার চূড়ান্ত গন্তব্য। দ্বীপের কাছে আসতে না আসতেই জলের বর্ণ–গন্ধ উত্তাপ আমূল পাল্টে যায়। হঠাৎ হঠাৎ শরীরে লাগে উষ্ণ জলের ছোঁয়া। জলের বর্ণও ক্রমেই ঘোলা হয়ে আসে—কুণ্ডলী পাকিয়ে চলতে থাকে পলিময় কাদার ঘোলাটে স্রোত। এই উষ্ণ ঘোলাটে স্রোতের ধারা পার হতেই নজরে আসে দ্বীপের প্রশস্ত সৈকত আর উৎসুক জনতা। আমাদের নৌকা থেমে যায় তীরের খুব কাছে, লাফিয়ে জলে নামে উৎসাহী বন্ধুরা। অভিযাত্রীর উজ্জ্বল লাল-সাদা-কমলা পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে কেউ একজন ছুটে আসে আমার দিকে। আর ঠিক তখনই নিঝুম দ্বীপের নরম মাটিতে লেগে যায় আমার হাত। পৌঁছে যাই নীল সমুদ্রের নীড়ে।