ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সত্যিই কি শক্ত অবস্থানে মোহাম্মদ বিন সালমান
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 11-02-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

সৌদি আরবের সঙ্গে গত কয়েক বছরে গোপন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে ইসরায়েল। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি খোলামেলা মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এর পর থেকে নানা কিছু ঘটতে শুরু করেছে।

নেতানিয়াহু গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে চ্যানেল ১৪-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌদি আরবের সঙ্গে গোপন সম্পর্কের কথা প্রকাশ করেন।

সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু দম্ভ করে বলেন, ‘প্রায় তিন বছর ধরে আমাদের মধ্যে গোপন সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের তরফে আমি ছাড়া আরও তিনজন এই সম্পর্কের কথা জানেন। তাদের (সৌদি) তরফেও অল্প কিছু লোক এটা সম্পর্কে জানেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারেও একই কথা।’

নেতানিয়াহু মাঝেমধ্যে এই ধরনের বানোয়াট দাবি করে থাকেন। এটা যদি তেমনটি না হয়ে সত্য হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, তা অপর পক্ষের সম্মতিক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে বা সম্পর্কের মেয়াদ শেষ হয়েছে বলেই তিনি তা প্রকাশ করেছেন। তাঁর এমন দাবির তৃতীয় সম্ভাবনা হলো ধমক দেওয়া। গত সপ্তাহে এই রকম অনেক ধমক দেওয়া হয়েছে।

তবে এটা বোঝা যায়, সৌদি ও ইসরায়েলের মধ্যে এ ধরনের সম্পর্ক হয়ে থাকলে তা রাষ্ট্রীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক হয়েছে।

মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) যুবরাজ হওয়ার আগে আর দশজন সাধারণ রাজপুত্রের মতো ছিলেন। তখন তাঁর এতটা পরিচিতি ছিল না। ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করতে গিয়ে তিনি রাজপরিবারের শক্তিশালী সদস্যদের কঠোর বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তখন তিনি বুঝেছিলেন, সৌদি আরবে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাতে হলে তেল আবিব ও ওয়াশিংটনের অনুগ্রহ লাভের বিকল্প নেই।

 

(বাঁ থেকে) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

(বাঁ থেকে) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুফাইল ছবি: রয়টার্স

এ পরিস্থিতিতে যুবরাজ ঘোষিত হওয়ার পর এমবিএস ইসরায়েলের সঙ্গে খাতির বাড়িয়ে দেন। ২০১৭ সালে তিনি গোপনে ইসরায়েল সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কট্টরপন্থী ইহুদিদের মতামতকে তোষামোদি করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিয়ে তিনি অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিলেন।

পরের বছর ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নিন্দা জানিয়ে যুবরাজ বিন সালমান বলেছিলেন, ফিলিস্তিনের উচিত ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনায় বসায় অথবা ‘চুপ থাকা’।

২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলের ওপর হামলা হওয়ার আগমুহূর্তে দেশটির সঙ্গে এমবিএসের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল। তখন ইসরায়েলর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল সৌদি আরব। আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে সই করতে মনস্থির করে ফেলেছিলেন এমবিএস। তবে হামাসের হামলার পরও ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে সৌদি আরব।

কারসাজির জায়গা নেই

১৫ মাসের যুদ্ধে সৌদি আরবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কোনো বিক্ষোভের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এমনকি দেশটিতে ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়ানো বা গাজাবাসীর জন্য প্রার্থনা নিষিদ্ধ ছিল। অথচ এ সময়ে দেশটিতে একের পর এক উৎসব লেগে ছিল।

দীর্ঘ যুদ্ধে গাজায় হতাহতের সংখ্যা হু হু করে বেড়েছে, একপর্যায়ে লেবাননে বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। যুদ্ধের শুরু থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সামরিক অভিযান লেগে ছিল। এসবের কোনো কিছুই সৌদি আরবের অবস্থানে পরিবর্তন আনতে পারেনি।

তবে যুবরাজ এমবিএস যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে ঘোরতরভাবে অপমানিত হতে রাজি ছিলেন না। ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি প্রথম বিদেশ সফরে কোন দেশে যাবেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সৌদি আরব। তবে এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির শর্ত জুড়ে দিয়েছেন তিনি।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এমবিএসের পক্ষ থেকে ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনে কথা বলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফোনালাপে ৬০০ বিলিয়ন ডলার চুক্তির প্রতিশ্রুতি দেন সৌদি যুবরাজ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সৌদি আরবের কাছ থেকে এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আবদার করে বসেন ট্রাম্প।

সুইজারল্যান্ডের দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি, তারা [সৌদি] এটা করবে। কারণ, আমরা তাদের সঙ্গে বেশ খুব ভালো ব্যবহার করেছি।’

এরপর গাজা ফিলিস্তিনি শূন্য করার পরিকল্পনা প্রকাশকালে ট্রাম্প বলেন, জঞ্জাল পরিষ্কারের অর্থ উপসাগরীয় দেশগুলোকেই বহন করতে হবে। এই কথা বলে তিনি মূলত সৌদি আরবের কথা বুঝিয়েছেন। এটা রিয়াদকে বিশেষ বিরক্ত করেছে।

ট্রাম্প এখানেই থামেননি। দম্ভ করে তিনি এটাও বলেছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়াই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে সৌদি আরব। তাঁর ভাষায়, ‘এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব বেশ উপকার করতে যাচ্ছে। তারা বেশ সহায়ক। তারা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি চায়। এটা খুবই সহজ।’

সৌদি আরবের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। ট্রাম্পের এই মন্তব্যের জবাব দিতে রিয়াদ সময় নিয়েছিল মাত্র ৪৫ মিনিট। মন্তব্য করার ক্ষেত্রে তেমন একটি রাখঢাকও করেনি দেশটি।

এক বিবৃতিতে রিয়াদ জানায়, ‘পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সৌদি আরবে বাদশাহ। দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা হবে না।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ অধিকারের যেকোনো ধরনের লঙ্ঘনকে দ্ব্যর্থহীনভাবে নাকচ করে সৌদি আরব। (এই অধিকার লঙ্ঘন) ইসরায়েলি বসতি স্থাপন নীতি, ভূমি দখল বা নিজের ভিটেমাটি থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদচেষ্টা—যেভাবেই হোক না কেন।...সৌদি আরব জোর দিয়ে বলতে চায়, এই শক্ত অবস্থানের সঙ্গে কোনো দর-কষাকষি এবং আপস করা হবে না।’

 

এর পর থেকে কথার যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।

গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে চ্যানেল ১৪-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু বলেন,‘সৌদিরা যদি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে এতই আগ্রহী হয়, তাহলে তারা তা তাদের ভূখণ্ডে করতে পারে।...তাদের প্রচুর জমি আছে।’

নেতানিয়াহুর কথায় আবর দেশগুলো আরও বিরক্ত হয়। মিসর, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) পাশাপাশি ইরাক, কাতার, কুয়েতসহ অন্যান্য আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলো নেতানিয়াহুর বক্তব্যের নিন্দা জানান।

গত রোববার দেওয়া এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহুর পরামর্শকে স্পষ্টভাবে নাটক বলে দিয়েছে রিয়াদ। এতে বলা হয়েছে, ‘(নেতানিয়াহু) গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি দখলদারিতে ক্রমাগতভাবে ঘটে চলে অপরাধ, জাতিগত নিধন থেকে মনোযোগ সরাতে (এ মন্তব্য করেছেন) এই নাটক করছেন।’

নিজদের ভূমিতে ফিলিস্তিনিদের অধিকার রয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তারা অনুপ্রবেশকারী বা অভিবাসী নন। তাই নৃশংস ইসরায়েলি দখলদারি চাইলেই তাঁদের (গাজা থেকে) বহিষ্কার করতে পারবে না।’

সেই যুগ এখন গত

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের শেষের দিকে ২০২০ সালে আব্রাহাম অ্যাকর্ডস শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এই উদ্যোগে কিছু দিনের মধ্যে আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো যুক্ত হয়। তখনো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেতানিয়াহু।

ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহু এই চুক্তির আসল উদ্দেশ্য না লুকিয়ে বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনকে এক পাশে সরিয়ে রাখতেই এটা করা হয়েছিল।’ একই সাক্ষাৎকারে সৌদি আরবকে তিরস্কার করতে ছাড়েননি তিনি।

আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের সূত্র ধরে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো, মুসলিম বিশ্ব নিয়েও আমি আশাবাদী। কারণ, (এটির মূল কথা হলো) শক্তির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা। আমরা যেহেতু শক্তিশালী, তাই এক হয়ে কাজ করলে এখন যেসব আপত্তি উঠছে এবং যেসব সব বিষয় অসাধ্য বলে মনে হচ্ছে, তা-ও একদিন বদলে যাবে।’

কয়েক দিন আগেও নেতানিয়াহু সৌদি যুবরাজ ও আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদকে বলেছিলেন, মিত্র হিসেবে বিবেচনা করেই তিনি তাঁদের সঙ্গে চুক্তি করবেন।

কিন্তু এখন নেতানিয়াহু বলছেন, বলপ্রয়োগ করে তিনি তাদের ওপর শান্তি চাপিয়ে দেবেন। ইসরায়েল সবাইকে জয় করতে শুরু করলে আরব বিশ্বের নেতারা তাঁর কাছে হামাগুড়ি দিয়ে আসবেন।

উল্লিখিত এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরব তার পররাষ্ট্রনীতি বদলাতে বাধ্য হয়েছে। উপায় না দেখে দেশটি এখন পাঁচ দশক আগের বাদশাহ ফয়সালের আরব জাতীয়তাবাদী দিনগুলোয় ফিরে গেছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৫ মাসের যুদ্ধে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চুপ থাকা আরব দেশগুলো এখন প্রথমবারের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে কিছু করার চেষ্টা করছে।

গলায় একটি কেফিয়াহ (ফিলিস্তিনি রুমাল) জড়িয়ে সম্প্রতি সৌদি আরবের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সাল বলেছেন, শুধু আরব ও মুসলিম বিশ্ব নয়, ইউরোপকেও সঙ্গে নিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘সম্মিলিত পদক্ষেপ’ নেওয়া হবে।

গাজা নিয়ে ট্রাম্পের প্রস্তাবের পর গত রোববার মিসর ঘোষণা করেছে, ‘নতুন এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতি’ নিয়ে আলোচনার জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি আরব লিগের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

 

শেয়ার করুন