ভারত থেকে পাকিস্তান, ইরান থেকে চীন—সবাই কেন তালেবানকে কাছে টানছে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 24-05-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

যে দেশের সরকারকে কেউই এখনো স্বীকৃতি দেয়নি, এমন একটি দেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলো ছিল অস্বাভাবিক ব্যস্ত।

আমির খান মুত্তাকি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এবং ইরান ও চীন সফর করেছেন। বেইজিংয়ে তিনি আবারও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। গত বুধবার পাকিস্তান ও চীনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নেন তিনি।

ঐতিহাসিকভাবে শাসক তালেবানের সঙ্গে এ দেশগুলোর অধিকাংশের সম্পর্ক একসময় ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। এমনকি এখনো আফগানিস্তান তাদের একসময়ের মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে।

 

 

জাতিসংঘ বা সংস্থাটির কোনো সদস্য রাষ্ট্রই তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তালেবানের কূটনৈতিক তৎপরতা প্রমাণ করে যে বৈশ্বিক মঞ্চে তারা সম্পূর্ণভাবে একঘরে হয়ে নেই।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠতে পারে, আফগানিস্তানের প্রতিবেশী একাধিক দেশ তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিয়েও কেন কূটনৈতিকভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছে?

এ প্রশ্নের জবাব পেতে তালেবানের সাম্প্রতিক উচ্চপর্যায়ের আঞ্চলিক তৎপরতাগুলো বিশ্লেষণ করেছে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা। তারা দেখেছে কেন ভারত, পাকিস্তান ও ইরান—এ তিন দেশ তালেবানের কাবুল দখলের চার বছর পর এ আফগান শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথা বলেছেন মুত্তাকি

১৯ এপ্রিল: পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল নিয়ে কাবুলে মুত্তাকি ও অন্যান্য আফগান কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উভয় পক্ষ পাকিস্তানের আফগান শরণার্থী প্রত্যাবাসন ইস্যু, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছে।

 

৬ মে: ইসহাক দার ও মুত্তাকি আবার কথা বলেন। পরে জানা যায় যে, এটি ছিল পাকিস্তানে ভারতের হামলার ঠিক আগের দিন। এরপর দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে (ভারত–পাকিস্তান) চার দিন ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের হামলা, পাল্টা–হামলা চলে। গত ২২ এপ্রিল ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় পাকিস্তান জড়িত বলে ভারত অভিযোগ করার পর এ সংঘাত শুরু হয়।

১৫ মে: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মুত্তাকির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ও পেহেলগাম হামলার নিন্দা জানানোয় তালেবানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

১৭ মে: ‘তেহরান ডায়ালগ ফোরাম’-এ অংশগ্রহণ করতে মুত্তাকি ইরানের রাজধানী তেহরানে পৌঁছান। সেখানে দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।

জাতিসংঘ বা সংস্থাটির কোনো সদস্য রাষ্ট্রই তালেবানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তালেবানের কূটনৈতিক তৎপরতা প্রমাণ করে যে বৈশ্বিক মঞ্চে তারা সম্পূর্ণভাবে একঘরে হয়ে নেই।

২১ মে: মুত্তাকি বেইজিং সফর করেন। আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকের লক্ষ্য ছিল, তিন দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।

কাতারের দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান সুহাইল শাহীন বলেন, ‘তালেবান আজকের আফগানিস্তানের বাস্তবতা। কারণ, তারা দেশের সব ভূখণ্ড ও সীমান্তের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে।’

সুহাইল শাহীন আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আঞ্চলিক দেশগুলো এই বাস্তবতা জানে এবং সেই অনুযায়ী তারা ইসলামিক এমিরেটের (আফগানিস্তান) সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ রাখে; যা আমার দৃষ্টিতে একটি বাস্তববাদী ও যুক্তিসংগত দৃষ্টিভঙ্গি।’ তালেবান আফগানিস্তানকে এ নামেই সম্বোধন করে।

সুহাইল আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব।’ পাশাপাশি তিনি যুক্তি দেন, ‘তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া আর দেরি করা উচিত নয়। আমাদের অঞ্চলের নিজস্ব স্বার্থ ও লক্ষ্য আছে, যেগুলো আমাদের প্রতিপালন করা উচিত।’

কেন ভারত তালেবানের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে

এটি একটি অপ্রত্যাশিত অংশীদারত্ব। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবানের প্রথম শাসনামলে ভারত সরকার আফগান গোষ্ঠীটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগে যায়নি এবং তাদের শাসনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তখন শুধু পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব তাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল।

একসময় ভারত আফগানিস্তানে সোভিয়েত-সমর্থিত মোহাম্মদ নজিবুল্লাহ সরকারের পক্ষ নিয়েছিল। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর কাবুলে নিজেদের দূতাবাস বন্ধ করে ভারত। দেশটি তালেবানকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি প্রক্সি বাহিনী হিসেবে দেখেছিল। আফগানিস্তানে মস্কোবিরোধী মুজাহিদদের সমর্থন দিয়েছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

তালেবান আজকের আফগানিস্তানের বাস্তবতা। কারণ, তারা দেশের সব ভূখণ্ড ও সীমান্তের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে।

—সুহাইল শাহীন, কাতারের দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান

 

তালেবানকে সমর্থন করার বদলে ওই সময় সংগঠনটির বিরোধী জোট ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’কে সমর্থন জানায় নয়াদিল্লি।

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তালেবান সরকার অপসারিত হওয়ার পর ভারত কাবুলে তার দূতাবাস আবার চালু করে ও আফগানিস্তানের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদারে পরিণত হয়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশটি অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পানি সরবরাহ প্রকল্পে ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) মার্কিন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে।

তবে, তালেবান ও তাদের মিত্র, বিশেষ করে হাক্কানি গোষ্ঠী ভারতের দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোতে বারবার প্রাণঘাতী হামলা চালায়।

এদিকে পশ্চিমা দেশগুলো–সমর্থিত দুর্নীতিবাজ আশরাফ গনি সরকারকে হটিয়ে ২০২১ সালের আগস্ট মাসে তালেবান দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসে আফগানিস্তানে। এবারও ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে দেশটি তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করে। প্রথমে এ যোগাযোগ পর্দার অন্তরালে হলেও ক্রমশ তা প্রকাশ্যে হতে শুরু করে। ২০২৩ সালে আফগানিস্তানে ভূমিকম্প হলে ভারত দেশটিতে মানবিক সহায়তাও পাঠায়।

নয়াদিল্লির এমন যোগাযোগ শুরু করার কারণ খুব সোজা। বিশ্লেষকেরা বলেন, এবার ভারত বুঝতে পেরেছে যে আগের মতো তালেবানকে এড়িয়ে চলার অর্থ হবে, প্রতিবেশী আফগানিস্তানের ওপর তার প্রভাব রাখার সুযোগকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে ছেড়ে দেওয়া।

২০২২ সালের জুন, তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ভারত কাবুলে নিজেদের দূতাবাস পুনরায় চালু করেছে এবং সেটি পরিচালনায় সেখানে ‘প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের’ একটি দল পাঠিয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে, তালেবান মুম্বাইয়ে আফগান কনস্যুলেটে একজন ভারপ্রাপ্ত কনসাল নিয়োগ দিয়েছে।

তালেবান প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের মতোই তেহরানও তাদের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সে সময় তালেবানের বিরোধী জোট নর্দান অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করে তেহরান, বিশেষ করে ১৯৯৮ সালে মাজার-ই-শরিফে তালেবান যোদ্ধাদের হাতে কয়েকজন ইরানি কূটনীতিক নিহত হওয়ার পর।

এরপর গত জানুয়ারিতে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ও তালেবান নেতা মুত্তাকি দুজনই এক বৈঠকের জন্য দুবাই যান। এটি ছিল এখন পর্যন্ত নয়াদিল্লি ও তালেবানের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরাসরি সাক্ষাৎ।

নয়াদিল্লিভিত্তিক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’–এর উপপরিচালক কবির তানেজা বলেন, ‘কাবুলে যে রাজনৈতিক বাস্তবতাই গড়ে উঠুক না কেন, তা এড়িয়ে যাওয়া ভারতের জন্য কখনোই কোনো বিকল্প ছিল না।’

‘তালেবান হচ্ছে বাস্তবতা। যদিও এ ব্যাপারে কেউ (ভারত) খুশি নয়। তবে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর ভারত আফগান জনগণের সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলার কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও, তা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি’, আল–জাজিরাকে বলেন তানেজা।

তানেজা আরও বলেন, ‘তালেবানের আদর্শিক ঘাঁটি বলে পরিচিত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসাটিও ভারতে অবস্থিত।’ তিনি যোগ করেন, ‘কোনো দেশ এবং তার বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক বিনাশ করা যায় না; বরং বাস্তবসম্মত ও ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তা মোকাবিলা করতে হয়।’

 

পাকিস্তানের হিসাব–নিকাশ কী

১৯৯৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তালেবানের অন্যতম প্রধান সমর্থক ছিল পাকিস্তান। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তালেবানের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।

আফগানিস্তানে ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে পাকিস্তানে সহিংস হামলা বেড়েছে। এগুলোর জন্য ইসলামাবাদ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো, যেমন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) দায়ী করছে। পাকিস্তানের দাবি, টিটিপি আফগান ভূখণ্ড থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং তালেবান সরকার তাদের আশ্রয় দিচ্ছে। অবশ্য, এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে তালেবান কর্তৃপক্ষ।

তালেবানের আদর্শিক ঘাঁটি বলে পরিচিত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসাটিও ভারতে অবস্থিত। কোনো দেশ এবং তার বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক বিনাশ করা যায় না; বরং বাস্তবসম্মত ও ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তা মোকাবিলা করতে হয়।

—কবির তানেজা, নয়াদিল্লিভিত্তিক ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর উপপরিচালক

 

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’র পটভূমিতে ২০০৭ সালে আবির্ভূত হয় পাকিস্তান তালেবান, যা দীর্ঘদিন ধরে সহিংস বিদ্রোহের মাধ্যমে ইসলামাবাদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছে। যদিও তারা আফগান তালেবান থেকে ভিন্ন, তথাপি আদর্শিকভাবে দুই গোষ্ঠীকেই কাছাকাছি মনে করা হয়।

লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ’-এর পরিচালক রাবিয়া আখতার বলেন, ‘ইসহাক দারের কাবুল সফর ও পরে মুত্তাকির সঙ্গে যোগাযোগকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বড় রকমের পরিবর্তনের ইঙ্গিত নয়; বরং একটি কৌশলগত, অস্থায়ী উষ্ণতা হিসেবে দেখা উচিত।’

সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সংকট চলাকালে, আফগানিস্তানের ভূখণ্ড পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ব্যবহারের আশঙ্কায় ইসলামাবাদ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে বলে মনে করেন রাবিয়া আখতার। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এটা (এ আশঙ্কা) ইসলামাবাদকে তার পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে আরও তাড়াহুড়া করতে বাধ্য করেছে।’

ইতিমধ্যে, চলতি বছরের শুরুতে পাকিস্তানের আফগান শরণার্থীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত—যাঁদের অনেকেই প্রায় পুরোটা জীবন পাকিস্তানে কাটিয়েছেন—এবং প্রায়শই সীমান্ত বন্ধ রেখে বাণিজ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করাও দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের অন্যতম কারণ।

রাবিয়া আখতার বলেন, বিশেষ করে শরণার্থীদের বিষয়টি ভবিষ্যতে দুই দেশের (পাকিস্তান–আফগানিস্তান) সম্পর্ক গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে।

‘পাকিস্তান যেখানে নথিহীন আফগানদের ফেরত পাঠাতে চাপ দিচ্ছে, কাবুল তা শাস্তিমূলক আচরণ হিসেবে দেখছে’, বলেন রাবিয়া আখতার। তিনি আরও বলেন, ‘যদি এ সংলাপ (পাকিস্তান ও তালেবান সরকারের) এ ইঙ্গিত দেয় যে উভয় পক্ষই বুঝতে পেরেছে সংঘাত টিকিয়ে রাখা টেকসই সমাধান নয়, বিশেষ করে যখন আঞ্চলিক মেরুকরণ ও অর্থনৈতিক চাপ পরিবর্তিত হচ্ছে, তবে তা একটি ইতিবাচক লক্ষণ।’

তালেবান কর্মকর্তা সুহাইল শাহীন বলেন, ‘কাবুল ইসলামাবাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চায়। তবে সেটি পারস্পরিক হওয়া উচিত। “দোষারোপের খেলা” কারও জন্যই উপকারী নয়।’

 

‘আমরা আমাদের দিক থেকে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিয়েছি’, বলেন সুহাইল। তিনি জানান, আফগানিস্তান পাকিস্তান সংলগ্ন সীমান্তরেখা বরাবর তল্লাশিচৌকি স্থাপন শুরু করেছে, যেন কেউ সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে। তবে, তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব, আমাদের নয়।’

চীন, বেইজিংয়ে বুধবার অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে জানায়, কাবুল ও ইসলামাবাদ নীতিগতভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নীত করতে সম্মত হয়েছে এবং উভয় দেশ (আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) যত দ্রুত সম্ভব নিজ নিজ রাষ্ট্রদূত পাঠাবে।

তবে আখতার মনে করেন না যে দুই প্রতিবেশীর (পাকিস্তান–আফগানিস্তান) মধ্যে ‘মূল অবিশ্বাস’, বিশেষ করে টিটিপিকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ঘিরে অবিশ্বাস অচিরেই দূর হবে।

আফগান ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বৈঠক করেন। দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জানুয়ারি ২০২৫

আফগান ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বৈঠক করেন। দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জানুয়ারি ২০২৫ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

 

তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে কী চায় ইরান

তালেবান প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের মতোই তেহরানও তাদের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সে সময় তালেবানের বিরোধী জোট নর্দান অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করে তেহরান, বিশেষ করে ১৯৯৮ সালে মাজার-ই-শরিফে তালেবান যোদ্ধাদের হাতে কয়েকজন ইরানি কূটনীতিক নিহত হওয়ার পর।

এ ঘটনার জেরে ইরান তার পূর্ব সীমান্তে হাজার হাজার সৈন্য জড়ো করেছিল এবং তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।

৯/১১ পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন ইরান নীরবে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে বলে ধারণা করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলা ও নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে তাদের সীমিত সহায়তাও প্রদান করে।

এরপর এখন থেকে প্রায় চার বছর আগে তালেবান আবার দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে ইরান কাবুলের এ শাসকদের সঙ্গে নিরাপত্তা, মানবিক সহায়তা ও বাণিজ্যসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা জানান।

দোহার তালেবান কার্যালয়ের প্রধান বলেন, অতীতে ইরান ও ভারত দুই দেশই মনে করত, তাদের গোষ্ঠী (তালেবান) ‘পাকিস্তানের প্রভাবাধীন’। এখন তারা জানে, এটি বাস্তব নয়। এই বাস্তবতার ভিত্তিতে তারা একটি নতুন, বাস্তবমুখী ও ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে; যা সবার জন্যই ইতিবাচক।’

 

 

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ইব্রাহিম বাহিস বলেন, আমির খান মুত্তাকি ও ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের মধ্যে বৈঠকটি তালেবানকে ‘সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার সম্ভাবনার’ ইঙ্গিত দেয় না। তবে তিনি বলেন, ‘বাস্তবমুখী বিবেচনা’ ইরানকে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগে প্ররোচিত করেছে। কারণ, আফগানিস্তানে তাদের ‘মূল স্বার্থ’ জড়িত আছে।

‘নিরাপত্তার দিক থেকে তেহরান আফগানিস্তানে আইএসআইএসের (আইএসআইএল) স্থানীয় শাখাকে দমন করতে মিত্র খুঁজছে। তেহরান আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণেরও চেষ্টা করছে, যা এখন তাদের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার’, ইব্রাহিম বাহিস আল–জাজিরাকে বলেন।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে কেরমানে দুটি আত্মঘাতী বোমা হামলাকে ইরানে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ হামলায় অন্তত ৯৪ জন নিহত হন। আফগানিস্তানভিত্তিক আইএসআইএলের শাখা ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশ (আইএসকেপি) এ হামলার দায় স্বীকার করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইএসকেপি তালেবানের শাসনের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কারণ তারা আফগানিস্তানজুড়ে একাধিক আলোচিত হামলা চালিয়েছে।

বাহিস আরও বলেন, তেহরানের প্রয়োজন একটি ‘আগ্রহী অংশীদার’, যারা ইরানে অবস্থানরত প্রায় ৭ লাখ ৮০ হাজার আফগান শরণার্থী ও হেলমান্দ নদী থেকে প্রবাহিত আন্তসীমান্ত পানির সমস্যা মোকাবিলায় সহযোগিতা করতে পারে।

২০২৩ সালের মে মাসে এ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে। এর ফলে সীমান্ত সংঘর্ষে দুই ইরানি সীমান্তরক্ষী ও একজন তালেবান যোদ্ধা নিহত হন।

এ সহিংসতা ঘটেছিল তৎকালীন ও বর্তমানে প্রয়াত ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সতর্কবার্তার পর। ওই সময় তিনি তালেবানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, তারা যেন ১৯৭৩ সালের চুক্তি লঙ্ঘন করে হেলমান্দ নদী থেকে ইরানের পূর্বাঞ্চলে পানির প্রবাহে বাধা না দেয়। আফগানিস্তানের তালেবান শাসকেরা ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।

শেয়ার করুন