ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গত ২৩ মার্চ ইসরায়েলি সেনারা কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ও একটি অগ্নিনির্বাপণের কাজে ব্যবহৃত ট্রাকে যে নির্বিচারে গুলি চালান, সে ঘটনার ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই ভিডিও চিত্রের সঙ্গে এ ঘটনা নিয়ে ইসরায়েলের দেওয়া বর্ণনার মিল নেই। ঘটনাটিতে ১৫ উদ্ধারকর্মী (চিকিৎসাকর্মী) নিহত হয়েছিলেন।
প্যালেস্টাইন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (পিআরসিএস) এ ভিডিও প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, অ্যাম্বুলেন্সসহ ওই গাড়িগুলো রাতের অন্ধকারে সম্মুখবাতি জ্বালিয়ে ও জরুরি ফ্লাশলাইট চালু রেখে ছুটে চলেছে। হঠাৎই এসব যানের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু হয়। পিআরসিএস বলেছে, ভিডিওটি একজন প্যারামেডিকের ফোন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তিনিও ওই ঘটনায় নিহত হন।
ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজন চিকিৎসাকর্মী ইতিপূর্বে বিবিসিকে বলেছেন, অ্যাম্বুলেন্সগুলো পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা ছিল এবং এগুলোর ভেতর ও বাইরের বাতি জ্বালানো ছিল।
এর আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) যানবাহনগুলোর সম্মুখবাতি জ্বালানো ও জরুরি সংকেত বাতি চালু রাখার কথা প্রাথমিকভাবে অস্বীকার করেছিল।
এখন ভিডিও প্রকাশিত হওয়ায় আইডিএফ বিবিসিকে বলেছে, ‘ওই ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত ভিডিও চিত্রসহ সব দাবি পুঙ্খানুপুঙ্খ ও গভীরভাবে পরীক্ষা করে দেখা হবে। এর মাধ্যমে ঘটনাক্রম ও পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে, তা বোঝার চেষ্টা করা হবে।’
ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজন চিকিৎসাকর্মী ইতিপূর্বে বিবিসিকে বলেছেন, অ্যাম্বুলেন্সগুলো পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা ছিল এবং এগুলোর ভেতর ও বাইরের বাতি জ্বালানো ছিল।
প্রকাশিত ভিডিওর বিষয়ে পিআরসিএস বলেছে, এ ভিডিও দৃশ্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে দেখানো হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, গুলিবর্ষণের মুখে অ্যাম্বুলেন্সসহ যানগুলো একটি রাস্তার ধারে থেমে যায়, তখনো সেগুলো থেকে আলো জ্বলছিল এবং অন্তত দুজন জরুরি কর্মী আলো প্রতিফলিত হয় এমন পোশাক পরে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন।
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে ইসরায়েলি বোমার আঘাতে আহত শিশুকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তিফাইল ছবি: রয়টার্স
যে যান থেকে ভিডিও করা হচ্ছিল, সেটির কাচের পর্দা ফেটে যেতে দেখা যায় এবং ছবি তোলার সময় কয়েক মিনিট ধরে গুলির শব্দ শোনা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, যিনি ভিডিও ধারণ করছিলেন, নিহত প্যারামেডিকদের একজন তিনি।
অ্যাম্বুলেন্সসহ বিধ্বস্ত যানগুলোর পাশে এই ১৫ জনের মরদেহ বালুচাপা দেওয়া ছিল। নিরাপদে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে কয়েক দিন ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা চালাতে হয়েছে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে।
হামলার ওই ঘটনার এক সপ্তাহ পর ঘটনাস্থলের একটি অগভীর খাদ থেকে ওই চিকিৎসাকর্মীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে তাঁর মুঠোফোন থেকে পাওয়া যায় ভিডিও ফুটেজটি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন আটজন প্যারামেডিক, গাজার ছয় বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মী ও জাতিসংঘের একজন কর্মী।
অ্যাম্বুলেন্সসহ বিধ্বস্ত যানগুলোর পাশে এই ১৫ জনের মরদেহ বালুচাপা দেওয়া ছিল। নিরাপদে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে কয়েক দিন ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা চালাতে হয়েছে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে।
ইসরায়েলের দাবি, ওই ঘটনায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসলামিক জিহাদের কয়েক সদস্য নিহত হয়েছেন। কিন্তু এ দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ সরবরাহ করেনি তারা। যানগুলোর আরোহীরা যে ইসরায়েলি সেনাদের জন্য হুমকি ছিলেন, সে বিষয়েও তারা কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
এ সপ্তাহের শুরুর দিকে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সারও আইডিএফের সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আইডিএফ এলোপাতাড়ি কোনো অ্যাম্বুলেন্সে হামলা করেনি।’
বেঁচে যাওয়া প্যারামেডিকদের একজন আইডিএফের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুললে এ বাহিনী ঘটনাটি তদন্ত করে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
দিন হোক আর রাত, একই ঘটনা ঘটে। (অ্যাম্বুলেন্সের) ভেতর ও বাইরের বাতি জ্বালানো থাকে। আপনি দেখলেই বুঝবেন, এগুলো অ্যাম্বুলেন্স ও তা ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের। গুলিবর্ষণের মুখে পড়ার আগপর্যন্ত যানগুলোর সব বাতি জ্বলছিল।
মুন্থার আবেদ, ইসরায়েলি হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া চিকিৎসাকর্মী
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্যারামেডিক মুন্থার আবেদ বলেন, ‘দিন হোক আর রাত, একই ঘটনা ঘটে। (অ্যাম্বুলেন্সের) ভেতর ও বাইরের বাতি জ্বালানো থাকে। আপনি দেখলেই বুঝবেন, এগুলো অ্যাম্বুলেন্স ও তা ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের। গুলিবর্ষণের মুখে পড়ার আগপর্যন্ত যানগুলোর সব বাতি জ্বলছিল।’
ইসরায়েলের ওই হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এই চিকিৎসাকর্মী কোনো ধরনের উগ্রপন্থার সঙ্গে তাঁর যুক্ত থাকার কথাও নাকচ করে দেন।
মুন্থার আবেদ বলেন, ‘ওই যানগুলোর আরোহীরা সবাই ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্টতা নেই। আমাদের প্রধান কাজ হলো, অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেওয়া ও জনগণের জীবনরক্ষায় এগিয়ে যাওয়া। এর বেশি বা কম নয়।’
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এলোপাতাড়ি কোনো অ্যাম্বুলেন্সে হামলা করেনি।
গিডিয়ন সার, ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
এদিকে গত শুক্রবার জাতিসংঘে বক্তব্য দানকালে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সভাপতি ইউনিস আল-খতিব প্রকাশিত ওই ভিডিওর প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘দলের যে কর্মীরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের একজনের কণ্ঠ আমি শুনেছি। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগে তাঁর সর্বশেষ কথা ছিল, “...মা আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আমি লোকজনকে শুধু সাহায্যই করতে চেয়েছিলাম। আমি মানুষের জীবনরক্ষায় কাজ করতে চেয়েছিলাম।” এটা হৃদয়বিদারক।’
ওই ঘটনাকে নৃশংস অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে রেড ক্রিসেন্টের এই কর্মকর্তা এটির নিরপেক্ষ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চান এবং দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানান।
২৩ মার্চের হামলার ওই ঘটনায় এখনো একজন চিকিৎসাকর্মী নিখোঁজ।