প্রো বেটার লাইফ (পিবিএল) বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড, রাঙ্গামাটি'র আয়োজনে গত ১৩ মে ২০২২ বিকাল ৪ঃ০০ টায় রাঙ্গামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে গুণীজন সম্মাননা ২০২২ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
পিবিএল এর চেয়ারম্যান মি. রন জ্যোতি চাকমা'র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গুণীজন সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাননীয় চেয়ারম্যান জনাব নিখিল কুমার চাকমা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কর্মী এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশের প্রাক্তন সদস্য মিজ নিরূপা দেওয়ান, শিক্ষাবিদ প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. কাঞ্চন চাকমা এবং অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মি. মিশন চাকমা। এছাড়াও অনুষ্ঠানে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজের প্রতনিধি, তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি, প্রিন্ট এন্ড মিডিয়া ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাষা, ক্রিড়া, সংস্কৃতি, ব্যবসা, সামাজিক বিকাশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে অবদান রাখায় তিনটি প্রতিষ্ঠান ও ৪ গুণীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশে অবদান রাখায় খাগড়াছড়ি জেলার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাবারাং কল্যাণ সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রামের ১ম নারী রেফারি যিনি ফিফা কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছেন জয়া চাকমা, শিল্প ও সংস্কৃতিতে শ্রী রণজিৎ দেওয়ান, সামাজিক কার্যক্রম, স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহ প্রদান, রক্ত দানের মাধ্যমে সহস্র মুমূর্ষু রোগীর জীবন দানকারী প্রতিষ্ঠান উন্মেষ স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন শাখায় চাকমা ফন্ট ইউনিকোড করণসহ আরও অনেকভাবে গুগলে চাকমা ফন্ট ব্যবহার ও উন্নয়নে অবদান রাখায় বিভূতি চাকমাকে, আদিবাসী সাহিত্য ও প্রকাশনা শাখায় অবদান রাখায় প্রমোদ বিকাশ চাকমাকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যতম ব্যবসায় উদ্যোক্তা পার্বত্য যানবাহন মালিক সমিতিকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।
অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে জাবারাং কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধি বিনোদন ত্রিপুরা বলেন, ২০০৬ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত মাতৃভাষা গবেষণা, বিকাশ ও উন্নয়নে দীর্ঘ পথ চলায় যারা পাশে থেকে ভূমিকা রেখেছেন সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। দাতা সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, একশন এইড বাংলাদেশ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP), বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশন (BNCU), তিন ভাষার ভাষা কমিটি, সংবাদ মাধ্যম ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী যাঁরা নানাভাবে জাবারাং কল্যাণ সমিতির পাশে ছিলেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এই অর্জন একদিনে আসেনি। আমরাও এমন কোন অর্জনের প্রত্যাশায় কাজ করিনি। নিবেদিত হয়ে কাজ করেছি শুধু নিজেদের মাতৃভাষার টানে। ১৯৯৭ সনের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দলিলে প্রত্যেক শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষার শিক্ষা পাবার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সে দিক বিবেচনা করেই ২০০৬সালে সেভ দ্য চিলড্রেন-এর সাথে আমাদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের পদযাত্রা। প্রথম যখন কাজ শুরু করি, ছিলনা প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাতৃভাষায় পারদর্শী কোন লেখক, মাতৃভাষায় লিখতে জানেন এমন সংখ্যাও ছিল অতি নগন্য। এরপরও বিদ্যমান সম্পদকে কাজে লাগিয়ে শুরু হলো কর্মযজ্ঞ। মার্তৃভাষায় শুরু হলো প্রশিক্ষণ, লেখক কর্মশালা, বর্ণ, ছড়া-গল্প লেখাগুলো লিগ্যাল সাইজের আর্টপেপারের উপর হাতে লিখে স্থানীয় আঁকিয়েদের ছবি দিয়ে মাস্কিন টেপ লাগিয়ে সূতা সেলাই করেই ৮-১০ পাতার বই বাধাঁই করা হয়েছে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিশুদের জন্য। স্মৃতি ধরে রাখতে সেই বইগুলোর কিছু অংশ এখনও সংরক্ষণ করা আছে। কর্মযজ্ঞ শুরুর প্রাক্কালে অনেক জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এ কাজের সমালোচনা করেছিলেন। আদৌ কি কখনও সরকার এমন কোন কর্মকান্ডের স্বীকৃতি দেবেন? কখনও কি সরকার আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় শেখার সুযোগ দেবে? এমন অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আন্তরিক ছিলেন দাতা সংস্থা গোষ্ঠী। আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তৎকালীন সরকার। জাতীয় শিক্ষা নীতিতে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়ার ঘোষণা এসেছে। তারই ফলশ্রতিতে এনসিটিবি ২০১৭ সাল থেকে ৫টি নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছে। বর্তমানে নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে। বই সরবরাহ হয়েছে। কিন্তু সরকার কর্তৃক শিক্ষক প্রশিক্ষণ, রুটিন নির্দেশনা কিংবা মাঠ পর্যায়ে মাতৃভাষায় শিক্ষা কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়নে কোন দিক নির্দেশনা নেই। এই সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে জাবারাং সংস্থাকে আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে অনুপ্রেরণা যোগাবে। পরিশেষে জাবারাং কল্যাণ সমিতিকে পিবিএল কর্তৃক সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত করার জন্য নির্বাচন করায় পিবিএল এবং জুরি বোর্ড কিংবা মনোনয়ন কমিটির সকল সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
পিবিএল কর্তৃক আয়োজিত গুণীজন সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা পিবিএল এর যুগোপযোগী উদ্যোগকে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত গুণীদের সাধনা, গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানান। পিবিএল এর মানবিক উন্নয়নমূলক সকল কাজের সাথে উন্নয়ন বোর্ড পাশে থাকার আস্বাস ব্যক্ত করেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পৃষ্ঠপোষক মিশন চাকমা এ প্রজন্মের তরুণদের একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হবার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। এ লক্ষে তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে পিবিএল-এর পাশে থাকবেন বলেও তিনি প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য সংকটের বিষয়েও তরুণ সমাজকে বিচক্ষণ হবার অনুরোধ জানিয়েছেন বিশেষ অতিথি শিক্ষাবিদ প্রফেসর মংসানু চৌধুরী।