পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টসহ সকল অবৈধ অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার এমপি। মঙ্গলবার (১৩ জুন) জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট তৎপর, যেখানে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, আমাদের সেনাবাহিনী তাদের ঘাঁটিগুলি গুড়িয়ে দিচ্ছে এবং কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে তারা কোণঠাসা করেছে। এখানে উন্নয়নের অন্যতম বাধা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা অবৈধ অস্ত্র নিয়ে ঘুরাঘুরি করছে, তাদের কাছ থেকে সেসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা দরকার এবং এসব অবৈধ অস্ত্রধারীদের আইনের আওতায় আনা দরকার, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের কাজ ত্বরান্বিত হয়।’
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘কিছু দিন আগে আমাদের কাপ্তাই আওয়ামী লীগের সভাপতি অংসুসাইন চৌধুরীর ছেলে চিৎমরম বাজারের বাজার চৌধুরী এবং যিনি আমাদের ইউনিয়ন যুবলীগের নেতা, তাকে অবৈধ অস্ত্রধারীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনীর মুভমেন্ট শুরু হলে তারা তাকে ছেড়ে দেয়। সেনাবাহিনীর মুভমেন্টের কারণেই সেখানে আমরা শান্তিতে আছি।’
সেনাবাহিনীর ওপর সন্ত্রাসীদের হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস সেটা নষ্ট করার জন্য তাদের উপর গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। তাদেরকে গুলি করে মারার ঘটনাও ঘটছে। আমি এর তীব্র নিন্দা করি। একই সঙ্গে আমরা আশা করব, সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা অবৈধ অস্ত্রধারী আছে, যারা চাঁদাবাজি করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ, একটি অঞ্চলে যদি শান্তি-শৃঙ্খলা স্থিতিশীল থাকে তাহলেই সেখানে উন্নয়ন সম্ভব। উন্নয়নের জন্য মানুষের স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা প্রয়োজন। তাই আমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সকলকে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’
বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠির উন্নয়নের জন্য এ বাজেট। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম এমন একটি এলাকা, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সংখ্যা অধিক। সে জন্যই অর্থমন্ত্রীকে আমরা ধন্যবাধ জ্ঞাপন করছি।’
পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান উন্নয়ন প্রসঙ্গে এমপি বলেন, ‘উন্নয়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে সড়ক পথে যোগাযোগ, পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমান্ত সড়ক নির্মিত হচ্ছে। সীমান্ত সড়ক নির্মিত হলে রাঙামাটির বিলাইছড়ি, জুড়াছড়ি এবং বরকলে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। নানিয়ারচরের সাথে এতদিন সড়ক যোগাযোগ ছিল না, সেখানে একটি ব্রিজ হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘতম ব্রিজ সেখানে নির্মিত হয়েছে। ফলে সেখানে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। বর্তমানে সেখানে বিরাটাকারে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হয়েছে।
পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা কেউ কখনো ভাবতে পারিনি, রাঙামাটির বরকল উপজেলার দূরবর্তী এলাকায় বিদ্যুৎ যাবে, সেখানেও এখন বিদ্যুৎ গেছে। বরকল, জুড়াছড়ি, বিলাইছড়িতেও এখন বিদ্যুৎ গেছে। যেখানে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব নয়, সেখানে সোলারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। পার্বচট্টগ্রাম বিদ্যুতায়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প আছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথম ফেজ এবং দ্বিতীয় ফেজের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রকল্পের তৃতীয় আরেকটি ফেজের কাজের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা অচিরেই বাস্তবায়িত হবে।’
পাহাড়ের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে, কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রাামকে উন্নয়নের হট স্পট বলে চিহ্নিত করেছেন। যার কারণে এখানে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে। প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে সরকারি কলেজ স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। আমাদের রাজস্থলী উপজেলায় দুটি কলেজ আছে, রাজস্থলী কলেজ এবং বাঙালহালিয়া কলেজ। বাঙালহালিয়া কলেজ যদি জাতীয়করণ করা হয়, তাহলে রাজস্থলী কলেজ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আবার রাজস্থলী কলেজ যদি জাতীয়করণ করা হয় তাহলে বাঙালহালিয়া কলেজ আপত্তি জানায়। এ অবস্থার কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনায় রাজস্থলীতে দুটি কলেজকেই জাতীয়করণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আর কোনো উপজেলায় দুটি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।’
কাউখালীর দুটি মৌজাকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা প্রসঙ্গে দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার দুটি মৌজা: ৯৫ক এবং ৯৫ নম্বর কাশখালী মৌজায় পাঁচ হাজার পরিবারের প্রায় ৩২ হাজার মানুষ বসবাস করে। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত ভেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, বর্তমানে যেটা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, পুলিশের স্পেশাল ট্রেনিং সেন্টার, শতাধিক স্কুল-মাদরাসা এবং ৭২টি মসজিদ-মন্দির আছে। ১৯৯৯ সালের ১ মার্চ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওই এলাকার ৬৩২৯ জমিকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৬১-৬২ সালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের বহু পরিবার এখানে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠিসহ সকলের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে রেকর্ডিয় জমির পাশাপাশি খাস জমিতে বসতি নির্মাণ করে তাদের দখলীয় জায়গায় ফলজ ও বনজ বাগান সৃজন করে জীবিকা নির্বাহ করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন থাকবে না, কেউ ভূমিহীন থাকবে না। কিন্তু পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের এই প্রজ্ঞাপনের কারণে এখন ওই এলাকার পাঁচ হাজার পরিবার ভূমিহীন হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে পড়েছেন। তাই এই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে, এলাকাটি ডি-রিজার্ভ করে এই পাঁচ হাজার পরিবার যেন সস্তিতে বসবাস করতে পারে, সে জন্য আমি বন ও পরিবেশ মন্ত্রীকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’
রাঙ্গামাটির থেগামুখে স্থল বন্দর নির্মাণে অনিশ্চয়তার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘রাঙামাটির থেগামুখে একটি স্থল বন্দর করার কথা। সেটা নিয়ে ভারতের সাথে সমঝোতাও স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্থল বন্দর নির্মাণের কাজ এগুচ্ছে না, এই কাজটা এগুনো দরকার। অন্যদিকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৩২০ মেগাওয়াট, বর্তমানে সেখানে অনাবৃষ্টির কারণে পানি শুকিয়ে গেছে। ফলে মাত্র ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। কাপ্তাই লেক ভরাট হয়ে গভীরতা কমে গেছে, সেকারণেই বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। সে জন্যই দ্রুত কাপ্তাই লেক ড্রেজিং করা প্রয়োজন।’
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির সদস্যদের আয়কর মুক্ত থাকার সুবিধা প্রসঙ্গে দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘আমি আমার সহকর্মী খাগড়াছড়ির এমপি কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরার সাথে একটি বিষয়ে একমত হয়ে বলতে চাই, পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রধান ভিত্তি ১৯০০ সালের রেগুলেশন। সেই রেগুলেশনের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে যে আয় করেন তার ভিত্তিতে কোনো ট্যাক্স দিতে হয় না। এখন যদি আয়কর সংক্রান্ত আইনটি সংশোধন করা হয়, তাহলে ১৯০০ সালের রেগুলেশন সংশোধন করতে হবে, শান্তি চুক্তি সংশোধন করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে একটি মহল রয়েছে, যারা চাইছে শান্তি চুক্তিকে বানচাল করতে, শান্তি চুক্তিকে বাতিল করতে। সেই ক্ষেত্রে এখন যদি ১৯০০ সালের রেগুলেশন এমেন্ডমেন্ট করা হয়, তাহলে শান্তি চু্ক্িতবিরোধী মহল উৎসাহীবোধ করবে। সে জন্য আমি মনে করি, আরো কিছুটা সময় দেয়া দরকার। আরো কিছু সময় দেয়ার পর আপনারা চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি আছে, তাদের উপর আয়কর বসাতে পারেন।’