গণহত্যার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ১০৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 05-02-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১০৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এই আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা গেছে ৩৪ জনকে।

ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত মামলা (মিস কেস) হয়েছে ১৬টি। এই মামলাগুলোতে আসামির সংখ্যা ১০৮। তবে একটি মামলারও তদন্ত প্রতিবেদন এখনো ট্রাইব্যুনালে জমা হয়নি। এই ১৬ মামলা এখন প্রাক্‌-বিচার পর্যায়ে রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ করলে এসব মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে।

গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় আড়াই মাস পর ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গণ-অভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুন, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে এই ট্রাইব্যুনালে। যদিও এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য।

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয় সূত্র বলছে, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যা ও গণহত্যা এবং আওয়ামী লীগের বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এ পর্যন্ত ৩০০টির মতো অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগ যাচাই–বাছাই করে ট্রাইব্যুনালে ১৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি মামলা হয়েছে গুমের ঘটনায়। বাকি ১৩টি মামলা হয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়।

১৬ মামলার মধ্যে ২টিতে আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। তাঁর বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ (একটি মামলায়) আনা হয়েছে। এ মামলায় ১৮ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য রয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরেকটি মামলা হয়েছে গুমের অভিযোগে। সেই মামলার শুনানি ১২ ফেব্রুয়ারি।

এখন পর্যন্ত একটি মামলাতেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না হওয়ার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত বিস্তৃত ও জটিল বিষয়। এই অপরাধ দেশজুড়ে সংঘটিত হয়েছে। ফলে মামলার সাক্ষী ও তথ্য-উপাত্ত বিপুল। আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে তদন্ত শেষ করতে যুক্তিসংগত সময় প্রয়োজন। বেশি তাড়াহুড়ো করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে ত্রুটি থাকতে পারে, এতে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। দেশবাসীর উচিত হতাশ না হয়ে যুক্তিসংগত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা। চলতি মাসের শেষ দিকে কিংবা মার্চের শুরুর দিকে দু-তিনটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।

তবে বিচারপ্রক্রিয়া যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না গণ-অভ্যুত্থানে নিহত শহীদ পরিবারের সদস্যরা। যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী ইমাম হাসানের (তাইম) ভাই রবিউল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, বিচার হবে বলে তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে, দমিয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু বিচারে তেমন অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছেন না তাঁরা। তদন্ত প্রতিবেদন দিতে দেরি হচ্ছে, আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। বিচারের সন্তোষজনক অগ্রগতি না হলে খুব শিগগির তাঁরা রাজপথে নামবেন।

ইমাম হাসান নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজী নগর এম ডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। তাঁর বাবা রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়া।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালফাইল ছবি

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার তদন্তে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে: চিফ প্রসিকিউটর

 

গ্রেপ্তার নিয়ে অসন্তোষ

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া দুটি মামলাতেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ভারতে অবস্থান করা হাসিনাকে গ্রেপ্তারের জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে রেড অ্যালার্ট জারি করতে অনুরোধ জানিয়েছে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। পাশাপাশি তাঁকে ফেরত চেয়ে ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে সরকার।

এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের মামলায় যে ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১৪ জন সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। তাঁরা হলেন আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, আমির হোসেন আমু, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ফারুক খান, শাজাহান খান, আব্দুর রাজ্জাক, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, কামরুল ইসলাম, জুনাইদ আহ্‌মেদ ও কামাল আহমেদ মজুমদার।

গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক সদস্য ১৮ জন। তাঁরা হলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন, জিয়াউল আহসান, মহিউদ্দিন ফারুকী, জসিম উদ্দিন মোল্লা, আবদুল্লাহিল কাফী, মইনুল ইসলাম, আলেপ উদ্দিন, মো. শাহিদুল ইসলাম, তানজিল আহমেদ, আবুল হাসান, মো. মাজহারুল ইসলাম, মো. আরাফাত হোসেন, মোহাম্মদ আরশাদ হোসেন, চঞ্চল চন্দ্র সরকার, মোহাম্মদ সুজন হোসেন, মুকুল চোকদার, হোসেন আলী ও আকরাম।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চিফ প্রসিকিউর কার্যালয়ে আরও একটি অভিযোগ

এ ছাড়া রয়েছেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব জাহাংগীর আলম।

অন্য আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় শুনানিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। আসামিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ অসহযোগিতা করে থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত ৩০ জানুয়ারি নির্দেশনা দেন ট্রাইব্যুনাল।

ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে তা কার্যকর করার দায়িত্ব পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি)। তাই প্রসিকিউটরদের কেউ কেউ মনে করেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে না পারার দায় সরকারের ওপরও বর্তায়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ট্রাইব্যুনালে যেসব আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হচ্ছে, তাঁদের বড় একটি অংশ পলাতক। তাঁদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, হাছান মাহমুদ, আসাদুজ্জামান খান ও মোহাম্মদ এ আরাফাত অন্যতম।

চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় মনে করে, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসামিদের গ্রেপ্তারে সহযোগিতার ঘাটতি রয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারি রাষ্ট্রকে ভূমিকা নিতে হবে। বিদেশে থাকা আসামিদের দেশে আনা এবং দেশে থাকা অপরাধীদের গ্রেপ্তার করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

গণহত্যার বিচার শেষ হবে ১ বছরের মধ্যে

তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত

ট্রাইব্যুনালের তদন্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ভিডিও, অডিও, ছবির মতো ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত। কারণ, গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রচুর ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে এবং করছে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন কার্যালয় ও তদন্ত সংস্থা।

জানা গেছে, সরকারি দপ্তরে থাকা গত জুলাই ও আগস্ট মাসের অনেক ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত মুছে ফেলা হয়েছিল। এর মধ্যে অনেক কিছু উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সব ডিজিটাল তথ্য-উপাত্তই বিশ্লেষণ বা ফরেনসিক করা হচ্ছে।

ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত ট্রাইব্যুনালের কাছে উপস্থাপনের আগে ফরেনসিক পরীক্ষা বা যাচাই-বাছাই করতে হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মাধ্যমে ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত যাচাইয়ের জন্য ট্রাইব্যুনালের কাছে অনুমতি নিয়েছে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের কাছে থেকে আসা নির্দেশনা কীভাবে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়েছে।

ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত ছাড়াও প্রসিকিউশন কার্যালয়ের তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটররা ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন। আহত ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের জবানবন্দি নেওয়া হচ্ছে। অভিযুক্তদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অন্যান্য নথিপত্রও ঘেঁটে দেখা হচ্ছে।

প্রসিকিউটরদের কেউ কেউ মনে করেন, গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা সদ্য ঘটেছে। এখনো বহু মানুষ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। গুম হওয়া অনেকে ফিরে এসেছেন। তা ছাড়া প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্য, আসামি—সব পক্ষই রয়েছে। ফলে অপরাধ প্রমাণের জন্য তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে বেগ পেতে হবে না।

সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিতের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের আহ্বান এইচআরডব্লিউর

 

সক্ষমতা ও চ্যালেঞ্জ

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তাঁর নেতৃত্বে মোট ১৪ জন প্রসিকিউটর রয়েছেন। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান মাজহারুল হক। তাঁর নেতৃত্বে মোট ১৭ জন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এই ৩১ জন প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তা দিয়ে সারা দেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত ও বিচারকার্যক্রম কতটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যাবে তা নিয়ে আলোচনা আছে।

চিফ প্রসিকিউটর প্রথম আলোকে বলেন, জনবল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকট রয়েছে। তবে অপরাধের বিস্তৃতির মাত্রার বিপরীতে তাঁদের কাজের যে অগ্রগতি, তা সন্তোষজনক। সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হলে দ্রুত কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তিন সদস্যের। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো.শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, তাড়াহুড়ো করলে যেমন বিচার মরে যায়, তেমনি দেরি করলেও বিচার মরে যায়। তাই এই দুটোর মাঝামাঝি একটি অবস্থানে থাকতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধসহ গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্তের জন্য দেশে প্রশিক্ষিত জনবল বা বিভাগ সেভাবে নেই। এসব নানা কারণে তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ায় হয়তো সার্বিকভাবে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি।

শেয়ার করুন