‘বিসিএস প্রিলি–লিখিতসহ গুরুত্বপূর্ণ ৩০ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস’ শিরোনামে দেশের অন্যতম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর গতকাল রোববার একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। এ সংবাদে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) ক্যাডার ও নন–ক্যাডারসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ করা হয়েছে। টিভি চ্যানেলটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ গত শুক্রবার (৫ জুলাই) অনুষ্ঠিত রেলওয়ের ৫১৬টি পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছে একটি চক্র। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বিসিএসসহ ৩০টি ক্যাডার ও নন–ক্যাডার পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত পিএসসির কয়েকজন কর্মকর্তা।
প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অনেক অভিযোগ আসতে শুরু করে। কয়েক বছর আগে থেকেই এসব অভিযোগের সূত্র মেলাতে কাজ শুরু করে চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের অনুসন্ধানী দল। খোঁজ মেলে এমন এক ব্যক্তির, যিনি চক্রটির কার্যক্রম খুব কাছ থেকে দেখেছেন।’ চক্রটির কার্যক্রম কাছ দেখা ওই ব্যক্তি বলেন, ‘তিনি (অভিযুক্ত ব্যক্তি) নিজ মুখে গল্প করতেন আমি চার–পাঁচজনকে বিসিএসে ক্যাডার বানিয়েছি। নন–ক্যাডার অফিসারও বানিয়েছি, বৈদেশিক ও কর্মসংস্থানে...। আমার কাছে সবকিছু হয়। তিনি আমাকে বলেন, ৩৩ ও ৩৪তম বিসিএসে কাজ করেছি চার–পাঁচটা ক্যাডার বানিয়েছি। ৩৫তম প্রিলিমিনারিতে আমি পড়াইছি।’ পিএসসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, ‘আমি দেখছি রাজস্ব কর্মকর্তার প্রশ্ন তিনি পান, অনেক পড়িয়ে ৫–৬ জনের চাকরি হয়। ওই চক্রটির কর্মকর্তা পরে পিএসসির নন–ক্যাডারের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এরপর এটিও, রাজস্ব কর্মকর্তা ও স্টাফ নার্সের ২০–২৫টা চাকরি হয় তাঁর মাধ্যমে।’
পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘উপপরিচালক হক মোহাম্মদ আবু জাফর স্যারের মাধ্যমে ২ কোটি টাকার বিনিময়ে ট্রাঙ্ক থেকে প্রশ্নপত্র আমাকে দিয়েছেন।’
বিপিএসসির নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির খবরের তথ্যগুলো মিলিয়ে নিতে টেলিভিশন চ্যানেলটি বেছে নেয় ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলীর নিয়োগ পরীক্ষাকে। প্রস্তুতি শেষে ছদ্মবেশী প্রার্থীকে তুলে দেওয়া হয় চক্রের সদস্যদের হাতে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ৫ জুলাই সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত যে প্রশ্নে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, হোয়াটসঅ্যাপে তার একটা কপি চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের হাতে আসে অন্তত ১ ঘণ্টা আগে। আর অজ্ঞাত স্থানে রেখে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষার্থীদের তা পড়ানো হয় আগের রাতেই। রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলীর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাওয়া এক ছদ্মবেশী টেলিভিশন চ্যানেলটিকে বলেন, ‘তাঁর যে প্রশ্ন দিয়েছিল, যা কমন ছিল, তাতে আমি সাড়ে ৮৫টি অ্যানসার করে এসেছি।’
১৫টি গোপন স্থানের খোঁজ পেয়েছে চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর। সেখানে ৩০০ শিক্ষার্থীকে রেলওয়ের প্রশ্ন পড়ানো হয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্যের স্বীকার করেছেন পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘উপপরিচালক হক মোহাম্মদ আবু জাফর স্যারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্রটি ২ কোটি টাকার বিনিময়ে ট্রাঙ্ক থেকে আমাকে দিয়েছেন। তিনি (সাজেদুল ইসলাম) অবগত আছেন ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।’
এরপর প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্যপ্রমাণ নিয়ে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইনের কাছে যায় চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর। সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘আমাদের কমিশনের যে ক্ষমতা আছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রমাণ হতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা প্রমাণিত হলে, কমিশন বিবেচনা করবে, পরীক্ষা থাকবে কি থাকবে না।’
পিএসসির অর্ধডজন কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত বলে সংবাদে দাবি করা হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুরো চক্রটিকে আইনের আওতায় আনতে কাজ শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
বিপিএসসির কতিপয় কর্মকর্তার নেতৃত্বে বিসিএসসহ অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে চক্রটি। চাকরি দিয়েছে অনেক অযোগ্য প্রার্থীকে। ফলে প্রজাতন্ত্রের কাজে দক্ষ ও উপযুক্ত কর্মচারী নিয়োগের যে উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠান, সেটিই এখন হুমকির মুখে।
এদিকে চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের প্রতিবেদন আমি দেখেছি। আমরা অভিযোগ খতিয়ে দেখছি। প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রমাণিত হতে হবে। আর প্রমাণিত হলে কী হবে, সেটি কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’