ব্যাংকঋণের উচ্চসুদ সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলোর মুনাফা খেয়ে ফেলছে। এ কারণে অনেক কোম্পানির বিক্রি বা ব্যবসা বৃদ্ধির পরও মুনাফা কমে গেছে। আবার কিছু কোম্পানি পরিচালন মুনাফা করার পরও ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে লোকসানে পড়েছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট খাতের কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
তালিকাভুক্ত সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর মালিকেরা বলছেন, ভারি এই শিল্পের ব্যবসায়ে নিয়মিত চলতি মূলধনসহ কাঁচামাল আমদানিতে বড় অঙ্কের ব্যাংকঋণ দরকার হয়। কারণ, কোম্পানিগুলো বড় বড় সরকারি–বেসরকারি প্রকল্পে বাকিতে সিমেন্ট সরবরাহ করে। এই ব্যবসার ধরনই এমন। এ কারণে ব্যাংকঋণের সুদ বাড়লে সিমেন্টসহ ভারী শিল্পগুলোর মুনাফায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।
দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট কোম্পানি সাতটি। এর মধ্যে পাঁচটি দেশীয় মালিকানাধীন; বাকি দুটি বহুজাতিক কোম্পানি। সিমেন্ট খাতের সাত কোম্পানির মধ্যে পাঁচটিরই মুনাফা সর্বশেষ প্রান্তিকে কমেছে। মুনাফা বেড়েছে মাত্র একটির। অপরটির লোকসান কিছুটা কমেছে।
সিমেন্ট খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা ক্রাউন সিমেন্টের। কোম্পানিটি গত জুলাই–ডিসেম্বরে ১ হাজার ৬২১ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কোম্পানিটির এই আয় বা বিক্রি ৯৩ কোটি টাকা বা ৬ শতাংশ বেশি। তারপরও কোম্পানিটির মুনাফা কমেছে ৪৮ কোটি টাকা বা প্রায় ৬৮ শতাংশ। আয় বা ব্যবসা বৃদ্ধির পরও কোম্পানিটির মুনাফা কমে যাওয়ার বড় কারণ ব্যাংকঋণের উচ্চসুদ।
ক্রাউন সিমেন্টের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির সুদ বাবদ খরচ ৩৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা বা ৭৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এ কারণে ভালো ব্যবসার পরও কোম্পানিটির মুনাফা উল্লেখযোগ৵ পরিমাণে কমেছে। গত বছরের জুলাই–ডিসেম্বর ছয় মাসে ক্রাউন সিমেন্ট মুনাফা করেছে ২৩ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৭১ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির মুনাফা কমে এক–তৃতীয়াংশ হয়ে গেছে। অথচ কোম্পানিটি ১৪৮ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছিল। যার বড় অংশ সুদব্যয় বাবদ পরিশোধ হয়েছে।
সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমে যাওয়ার পেছনে ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ একটি বড় কারণ। এ ছাড়া সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে জাহাজা ভাড়া ও কাঁচামাল আমদানির ওপর অগ্রিম আয়কর বৃদ্ধির ফলে খরচ বেড়েছে।
আলমগীর কবির, সভাপতি, বিসিএমএ
জানতে চাইলে ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান ও সিমেন্ট শিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, সিমেন্ট কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমে যাওয়ার পেছনে ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ একটি বড় কারণ। এ ছাড়া সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে জাহাজভাড়া ও কাঁচামাল আমদানির ওপর অগ্রিম আয়কর বৃদ্ধির ফলে খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এ কারণে আয় বাড়লেও অনেক কোম্পানির মুনাফা কমছে। ক্রাউন সিমেন্টের মুনাফা কমে যাওয়ার পেছনেও ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ, পরিবহন ও কাঁচামালের খরচ বেড়ে যাওয়ার বড় প্রভাব ছিল।
ক্রাউন সিমেন্টের ব্যাংকঋণের খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে আলমগীর কবির বলেন, ‘উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন ইউনিট স্থাপনের কারণে আমাদের ব্যাংকঋণের পরিমাণ বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে ঋণের সুদহারও। এই দুই কারণে আমাদের সুদ বাবদ খরচ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।’
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিমেন্ট খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর আরেকটি প্রিমিয়ার সিমেন্ট। কোম্পানিটি গত জুলাই–ডিসেম্বরে ১ হাজার ৬১ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। আর এ সময়ে কোম্পানিটির পরিচালন মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ কাঁচামাল, প্রশাসনিক ও পণ্য বিতরণের খরচ বাদ দেওয়ার পর এই মুনাফা করে কোম্পানিটি। সেই মুনাফার ৮৬ কোটি টাকা ঋণের সুদ পরিশোধে খরচ হয়ে গেছে। ফলে গত জুলাই–ডিসেম্বর শেষে মুনাফা কমে ৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। অথচ ২০২৩ সালের একই সময়ে কোম্পানিটি ২৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির মুনাফা ২৪ কোটি টাকা বা ৮৫ শতাংশ কমেছে। এ সময়ের ব্যবধানে প্রিমিয়ার সিমেন্টের সুদ বাবদ খরচ ৩৭ কোটি টাকা বা ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।
দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত বছরের শেষ ছয় মাসে বিক্রি কমেছে। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ঋণের সুদ বাবদ খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। ফলে মুনাফায় বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে।
মোহাম্মদ আমিরুল হক, এমডি, প্রিমিয়ার সিমেন্ট
জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত বছরের শেষ ছয় মাসে বিক্রি কমেছে। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ঋণের সুদ বাবদ খরচ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। ফলে মুনাফায় বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে।
এদিকে সিমেন্ট খাতের যেসব কোম্পানির ব্যাংকঋণ কম, সেসব কোম্পানির মুনাফায় বড় ধরনের কোনো ধাক্কা লাগেনি। যেমন তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি হাইডেলবার্গ সিমেন্ট। কোম্পানিটি গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে প্রায় ৫৯ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করেছে। তাদের খুব বেশি ব্যাংকঋণ নেই। তাই উল্লিখিত সময়ে কোম্পানিটির মুনাফার পরিমাণ ছিল ৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণ না থাকায় কোম্পানিটিকে সুদ বাবদ বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। তাতে মুনাফায় বড় ধরনের কোনো ধাক্কাও লাগেনি।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সিমেন্টশিল্পে ব্যাংকনির্ভরতা বেশি। কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে ব্যবসার নানা প্রয়োজনে চলতি মূলধনের জন্য এই খাতের কোম্পানিগুলোকে ব্যাংকের শরণাপন্ন হতে হয়। আবার ব্যবসা সম্প্রসারণেও লাগে ব্যাংকঋণ। কারণ, এই খাতের ব্যবসার বড় অংশই বাকিতে হয়। তবে যাঁরা নগদ অর্থে ব্যবসা করে, তাদের ব্যাংকনির্ভরতা কম। তাই যেসব কোম্পানির ব্যাংকঋণ বেশি, সুদ বৃদ্ধির কারণে তাদের মুনাফাও তত বেশি কমছে।