অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নির্বাচনপদ্ধতি পরিবর্তন নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ বিদ্যমান পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবর্তে ভোটের আনুপাতিক হারে বা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। তবে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি এই পদ্ধতি চায় না। তারা বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। আর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের অবস্থান জানা সম্ভব হয়নি।
গত শনিবার ‘রাষ্ট্র সংস্কার ও সংবিধান সংশোধনী’ বিষয়ে এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় বিশিষ্টজনেরা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চালু করার পক্ষে মত দেন। আলোচনায় বলা হয়, স্বৈরশাসন ঠেকাতে হলে সবচেয়ে বেশি কার্যকর পন্থা হবে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন।
গত শনিবার রাজধানীতে একটি সেমিনারে বিএনপি, সিপিবি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও গণ অধিকার পরিষদের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। এর মধ্যে বিএনপি ছাড়া অন্য দলগুলো আনুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে নিজেদের মত দেয়। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী তাদের সংস্কার প্রস্তাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছে।
জাপা, জামায়াত, এবি পার্টি, সিপিবি, গণসংহতি আন্দোলনসহ অনেকেই নির্বাচনপদ্ধতি পরিবর্তনের পক্ষে। বিএনপি পরিবর্তন চায় না।
সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন হলো আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকবে না। ভোটাররা দলীয় প্রতীকে ভোট দেবেন। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে সংসদের আসন বণ্টন হবে। মূলত বিভিন্ন দেশে তিনটি পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্পন্ন হয়—মুক্ত তালিকা, বদ্ধ তালিকা ও মিশ্র পদ্ধতি।
মুক্ত তালিকায় নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সময়ের মধ্যে দলগুলো প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। ফল প্রকাশের পর প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী আনুপাতিক হারে তালিকার ক্রমানুযায়ী আসন বণ্টন হয়। বদ্ধ পদ্ধতিতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয় না। আর মিশ্র পদ্ধতিতে কিছু আসনে সমানুপাতিক ও কিছু আসনে আসনভিত্তিক নির্বাচন হয়। আবার কোনো কোনো দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রচলন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোথাও এক কক্ষে সমানুপাতিক আবার অন্য কক্ষে আসনভিত্তিক নির্বাচন হয়।
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আনুপাতিক পদ্ধতি চালু করার দাবি নতুন কিছু নয়। কিছু রাজনৈতিক দল অনেক দিন ধরেই এই দাবি জানিয়ে আসছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৭ সালে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল নির্বাচন কমিশন। সেই আলোচনায় জাতীয় পার্টি, সিপিবি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) কিছু দল এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে ওয়ার্কার্স পার্টি বিদ্যমান পদ্ধতির পাশাপাশি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিধান করা অর্থাৎ মিশ্র পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব দিয়েছিল।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হাবিবুল আউয়াল কমিশনের ডাকা সংলাপেও জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এ ছাড়া আরও কিছু জটিলতাও আছে। রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি করে শিগগিরই এই পদ্ধতির প্রচলন করা কঠিন হতে পারে। বর্তমান পদ্ধতিতে কোনো দলকে এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেতে হয়। অর্থাৎ তাদের ১৫০টির বেশি আসন পেতে হয়। এককভাবে না পেলে কোয়ালিশন বা জোট সরকার করা যায়। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কোনো দলের পক্ষে এককভাবে সরকার গঠন করা কঠিন হয়ে যেতে পারে।
আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সর্বসম্মতি ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হবে না। আর আবশ্যিকভাবে সংসদে শক্ত বিরোধী দল থাকবে।
সংসদবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ
জনপরিসরে নতুন নির্বাচনপদ্ধতি চালু করার বিষয়ে আলোচনা শুরু হলেও অন্তর্বর্তী সরকার এখনো এ বিষয়ে তাদের চিন্তার কথা জানায়নি। সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সবে কাজ শুরু করেছে। তাদের প্রস্তাবে বিষয়টি আসবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
দীর্ঘদিন ধরেই আনুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে জাতীয় পার্টি। দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বেশির ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না। যেমন একটি নির্বাচনে তিনি পেয়েছিলেন সাড়ে ৬২ হাজার ভোট। আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছিলেন ৬২ হাজার ভোট। আর বিএনপির প্রার্থী ৬৩ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। অর্থাৎ এখানে এক লাখের বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়নি, হয়েছে ৬৩ হাজারের। আনুপাতিক পদ্ধতিতে বেশির ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার সুযোগ আছে। তা ছাড়া এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কালোটাকার ব্যবহার ও নির্বাচনী অনেক কারচুপি কমবে।
অবশ্য এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে এই পদ্ধতি নিয়ে মতানৈক্য আছে। বিএনপি বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন একটি সংস্কৃতিরও বিষয়। দেশে প্রথম থেকে ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। তাঁরা এই পদ্ধতিতেই থাকার পক্ষে। যদি এই পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে সেখানে জনগণের সম্মতি প্রয়োজন হবে। সামনের নির্বাচনে এটি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, যেসব সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। যে বিষয়গুলোয় ঐকমত্য হবে না বা ভিন্নমত থাকবে সেগুলো এখন সংস্কারের সুযোগ নেই।
এবি পার্টিসহ কোনো কোনো দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির পক্ষে হলেও তারা এ বিষয়ে আগে ঐক্য চায়।
এখানে ভোটের হার বা সারা দেশে কোন দল কত ভোট পেল, তা কোনো বিষয় নয়। কত আসন পেল, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকলে একক প্রার্থীকে ভোট ছাড়াই বিজয়ী ঘোষণা করা যায়।
বিশ্বব্যাপী দুই ধরনের নির্বাচনপদ্ধতি বেশি প্রচলিত। এর একটি ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ বা এফপিটিপি এবং অন্যটি ‘প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ বা পিআর নামে পরিচিত। দেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ গঠিত হয় ৩৫০ জন সদস্য নিয়ে। এর মধ্যে ৩০০ জন নির্বাচিত হন একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাগুলো থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। আর নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসনে নির্বাচন হয় দল বা জোটগুলোর পাওয়া আসনের সংখ্যানুপাতে।
একক নির্বাচনী এলাকা হলো সংসদীয় আসন। এখন দেশে নির্বাচন হয় সংসদীয় আসনভিত্তিক, এটি এফপিটিপি হিসেবে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে একটি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনি নির্বাচিত হন। এখানে ভোটের হার বা সারা দেশে কোন দল কত ভোট পেল, তা কোনো বিষয় নয়। কত আসন পেল, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকলে একক প্রার্থীকে ভোট ছাড়াই বিজয়ী ঘোষণা করা যায়।
প্রধানমন্ত্রীকে স্বৈরাচারী হওয়ার পথ ঠেকানোর একমাত্র রাস্তা হলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি। কারণ, এই পদ্ধতিতে ভোট হলে কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
সংসদবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ
এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে অপরিচিত হলেও বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি, অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ দেশে আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত। উন্নত দেশগুলোর সংস্থা অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো–অপারেশনভুক্ত (ওইসিডি) ৩৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ দেশই আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা অনুসরণ করে।
নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের বিদ্যমান নির্বাচনপদ্ধতি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়। এ ক্ষেত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর ও সর্বোত্তম পন্থা।
গত ১৭ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির সরকার ও নির্বাচন’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। সেখানে তিনি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হয় ব্যক্তি-প্রার্থীর পরিবর্তে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। ৩০০ নির্বাচনী এলাকা থাকবে না। বাংলাদেশ হবে একটি একক নির্বাচনী এলাকা। নির্বাচনে যে দল মোট প্রদত্ত ভোটের যত শতাংশ পাবে, সেই অনুপাতে সংসদে আসন লাভ করবে।
বর্তমান পদ্ধতিতে কোনো দলকে এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেতে হয়। অর্থাৎ তাদের ১৫০টির বেশি আসন পেতে হয়। এককভাবে না পেলে কোয়ালিশন বা জোট সরকার করা যায়। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কোনো দলের পক্ষে এককভাবে সরকার গঠন করা কঠিন হয়ে যেতে পারে।
সংসদবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে স্বৈরাচারী হওয়ার পথ ঠেকানোর একমাত্র রাস্তা হলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি। কারণ, এই পদ্ধতিতে ভোট হলে কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বিগত নির্বাচনগুলোর হিসাবে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট হলে কোনো দল এককভাবে সরকারই গঠন করতে পারত না। জোট সরকার করতে হতো।
অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন মনে করেন, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যারাই পেয়েছে, তারা নিজেদের স্বার্থে সংবিধান সংশোধন করেছে। আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সর্বসম্মতি ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হবে না। আর আবশ্যিকভাবে সংসদে শক্ত বিরোধী দল থাকবে।