তিস্তাপারে নদীভাঙনের শিকার মানুষের কষ্টের কথা উল্লেখ ও তিস্তা নদীতে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কঠোর সমালোচনা করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘একদিকে ভারত পানি দেয় না, আরেক দিকে আমাদের যে শত্রু, তাঁকে দিল্লিতে রাজার হালে বসিয়ে রেখেছে। ওখান থেকে তিনি বিভিন্ন রকম হুকুম জারি করেন। কী করুণ অবস্থা তাঁদের (ভুক্তভোগী মানুষ)। আজকে একদিকে তারা (ভারত) পানি ছেড়ে দেয়, পানির তোড়ে ঘরবাড়ি, সম্পদ ভেসে যায় ও নষ্ট হয়। আবার যখন বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়, তখন এই এলাকার খরায় শুকিয়ে খটখট হয়ে যায়। তিস্তাপারের মানুষের দুঃখ আর যায় না।’
আজ সোমবার বিকেলে ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি’র অবস্থান কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কথা বলেন। তিস্তার রেলসেতু ও সড়কসেতুর লালমনিরহাট প্রান্তে নদীর বালুচরে ৪৮ ঘণ্টার এই অবস্থান কর্মসূচি আজ বেলা সাড়ে তিনটায় শুরু হয়।
মির্জা ফখরুল তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা বহুদিন আগে থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য কথা বলছি। আওয়ামী লীগের সরকার এল। শুরুর দিকে সবাই ভাবল, ভারতের বন্ধু আওয়ামী লীগ। সুতরাং তিস্তার পানি বোধ হয় এবার পাব। কিন্তু ১৫ বছরে লবডঙ্কা। অর্থাৎ কিছুই না। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বেচে দিয়েছেন, কিন্তু তিস্তার এক ফোঁটা পানিও আনতে পারেন নাই।’
শুধু তিস্তা নয়, ৫৪টি অভিন্ন নদীর উজানে ভারত বাঁধ দিয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ভারত বাঁধ দিয়ে পানি তুলে নিয়ে গিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আর আমাদের দেশের মানুষ পানির অভাবে ফসল ফলাতে পারেন না। জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে পারেন না। নদীপারের প্রত্যেকটি মানুষকে আজকে এই কষ্টের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এই সময়ে তিস্তা বাঁচানোর ডাক আমাদের অন্তরের সবার দাবি।’
তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচিতে মানুষের ঢল নেমেছে। সোমবার লালমনিরহাটের তিস্তা রেলসেতু এলাকায়
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চের ইতিহাস উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘মরহুম জননেতা একদিন ফারাক্কা মার্চ করেছিলেন গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য। আজকে একইভাবে আসাদুল হাবিব দুলু (বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক) তিস্তার ১১টি পয়েন্টে হাজার হাজার মানুষকে জড়ো করে ডাক দিয়েছেন, “জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই”। এটা কোনো স্লোগান নয়, এটা তিস্তাপারের মানুষের বাঁচার আহাজারির আওয়াজ উঠে আসছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকের এই সরকারকে পরিষ্কার করে বলতে চাই, অন্তর্বর্তী সরকার, আপনারা তো বলেন আপনারা নিরপেক্ষ। নিরপেক্ষ কিন্তু এই জায়গায় থাকলে চলবে না। এই জায়গায় আপনাকে মুখ খুলতে হবে। ভারতকে বলতে হবে, আমার পানির ন্যায্য হিস্যা আমি চাই। লড়াই না করলে কিছু পাওয়া যায় না। এ লড়াই করেই আমরা তিস্তার পানি আনব। আমাদের অধিকারগুলো আদায় করে নেব।’
প্রতিবেশী ভারতের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ভারতকে স্পষ্ট করে বলতে চাই, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব করতে চান, তাহলে আগে তিস্তার পানি দেন। সীমান্তে গুলি করে হত্যা বন্ধ করেন। আর আমাদের সঙ্গে বড় দাদার মতো আচরণ বন্ধ করেন। আমরা আমাদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারি। আমরা অবশ্যই ভারতকে বন্ধু হিসেবে দেখতে চাই, যে বন্ধুত্ব হবে সম্মানের সঙ্গে।’
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির লাগাতার ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ওরা অনেক সময় বলে, আমরা নাকি ভোট ভোট করি। ভোট ভোট করার কারণ একটাই, ভোট না হলে নেতা নির্বাচিত হবে কোথা থেকে। আমাদের কথা বলবে কে? আমরা তো প্রতিনিধি চাই। এ জন্যই আমরা নির্বাচনের কথা বলি। নির্বাচন দিলে দেশে যে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে, সেই অশান্তি হবে না। শান্তি আসবে, একটা স্থিতিশীলতা আসবে।’
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘আমরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। সেই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। দেশের মানুষ ১৫ বছর ভোট দিতে পারেননি। তাঁরা ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে চান। ভোট আমরা চাই।’
আজ সকাল থেকে তিস্তাপারের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ অবস্থান কর্মসূচিতে জমায়েত হন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বক্তব্য শুরু হলে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সংগীতশিল্পী বেবী নাজনীন প্রমুখ বক্তব্য দেন।
সভাপতির বক্তব্যে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী ও রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব বলেন, ‘তিস্তাপারের পাঁচ জেলার লাখো ভাগ্যাহত মানুষ ১১টি স্থানে একই দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। আমরা পানিবৈষম্যের শিকার হয়েছি, উন্নয়নবৈষম্যের শিকার হয়েছি। আমরা এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। রংপুরকে বিরানভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। ছিন্নমূল মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়ে, বাড়িঘর হারিয়ে দেশান্তরিত হয়েছেন। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা চাই এবং অনতিবিলম্বে যেন তিস্তা মহাপরিকল্পনা চালু করা হয়। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
আগামীকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় তিস্তা সেতু থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত গণপদযাত্রা, তিস্তার পানিতে নেমে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন, সংগীত পরিবেশনা হবে। সন্ধ্যায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বক্তব্য দেবেন। এ ছাড়া তথ্যচিত্র ও সিনেমা প্রদর্শন করা হবে।