কাঠগড়ায় হাসিমুখে আনিসুল, বিমর্ষ সালমান, আদালতকক্ষে হট্টগোল
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 29-01-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আজ বুধবার সকাল ১০টায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের হাজতখানার প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর ডান হাতে হাতকড়া পরানো। পাশে কয়েকজন পুলিশ সদস্য সতর্ক প্রহরায় দাঁড়িয়ে।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ইশারা পাওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা সালমান এফ রহমানসহ অন্য আসামিদের নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। সালমান এফ রহমানের সামনে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তাঁর বাম হাতে হাতকড়া পরানো।

ধীরে ধীরে তাঁদের আদালত ভবনের নিচতলা থেকে দুই তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁদের নেওয়া হয় আসামির কাঠগড়ায়। তখন তাঁদের মাথা থেকে হেলমেট খুলে রাখেন পুলিশ সদস্যরা।

 

সময় তখন সকাল ১০টা ১০ মিনিট। বিচারক তখনো এজলাসে আসেননি। কাঠগড়ার একপাশে সালমান এফ রহমান তাঁর আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন।

সালমান এফ রহমানের খানিকটা দূরে আনিসুল হকও তাঁর আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। এর মধ্যে বিচারক এজলাসে আসেন।

হট্টগোল

বিচারক এজলাসে আসার কিছুক্ষণ পর কয়েকজন আইনজীবী একজন সাংবাদিককে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আপনি কি মোবাইলে ছবি তুলছেন?’

তখন ওই সাংবাদিক বলেন, তিনি কোনো ছবি তোলেননি।

এরপর আরেকজন আইনজীবী সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা এখানে কেন? সাংবাদিকেরা আদালতকক্ষে কেন?’

এর কিছুক্ষণ পর আরেকজন আইনজীবী একজন সাংবাদিককে লক্ষ্য করে বলেন, ‘আপনি এখানে কেন ছবি তুলছেন?’

তখন ওই সাংবাদিক বলেন, তিনি কোনো ছবি তোলেননি।

এ সময় আইনজীবীরা চিৎকার করতে থাকেন। এতে আদালতকক্ষে হট্টগোল পরিস্থিতি তৈরি হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংবাদিক ভাইয়েরা আদালতকক্ষে মামলার শুনানির সময় থাকবেন, খবর সংগ্রহ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো আইনজীবী বা অন্য কেউ যদি সাংবাদিকদের খবর সংগ্রহের বাধাগ্রস্ত করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শুনানি

প্রথমে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তখন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণকে উত্তরা পশ্চিম থানা একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়। তাঁকে ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়।

রিমান্ডে নেওয়ার সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি আদালতকে বলেন, উত্তরা এলাকায় ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, তাঁর দলের লোকজন বহু শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করেছেন। আসাদুর রহমান জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তবে আসামি পক্ষ থেকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন নাকচের আবেদন করা হয়।

 

 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে আজ বুধবার আদালতে হাজির করা হয়। সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণ, ঢাকা, ২৯ জানুয়ারি

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে আজ বুধবার আদালতে হাজির করা হয়। সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণ, ঢাকা, ২৯ জানুয়ারি

আসাদুর রহমানের রিমান্ড শুনানির সময় আনিসুল হককে তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। এ সময় সালমান এফ রহমানকে বিমর্ষ দেখা যায়। তবে এ সময় সালমান এফ রহমানের অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা আনিসুল হক হাসিমুখে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল আল–মামুনের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন।

শুনানি নিয়ে আসাদুর রহমানের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এরপর ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের রিমান্ডে শুনানি শুরু হয়।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, বাড্ডা ও রামপুরা এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী আসামি আতিকুল ইসলাম।

আতিকুল ইসলামের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, তাঁদের মক্কেল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন না। বরং আন্দোলনের সময় আহত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিয়েছেন। তিনি কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।

 

আদালত আতিকুলকে বাড্ডা থানায় দায়ের করা সুমন সিকদার হত্যা মামলায় তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড আদেশের পর আতিকুলকে বিমর্ষ অবস্থায় দেখা যায়।

এরপর সাবেক সিনিয়র সচিব মো. মহিবুল হককে ধানমন্ডি থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে পুলিশ। যখন এই গ্রেপ্তার আবেদনের শুনানি চলছিল, তখন সালমান এফ রহমানকে আনিসুল হকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। প্রায় এক মিনিট ধরে দুজন কথা বলতে থাকেন।

কিছুক্ষণ পর আনিসুল হকের কাছ থেকে অন্য পাশে সরে আসেন সালমান এফ রহমান।

 

আনিসুল হক বললেন, ‘উনি কে’

তখনো আনিসুল হকের রিমান্ড শুনানি শুরু হয়নি। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ড শুনানি চলাকালে আনিসুল হক বেশ কয়েকবার সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন।

একপর্যায়ে কাঠগড়ার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ সদস্যের কাছে আনিসুল হক চোখের ইশারায় আরেকজনকে দেখিয়ে জানতে চান, ‘উনি কে?’

আনিসুল হকের ঠিক বিপরীতে বেশ দূরে বেশ কয়েকজন পুলিশ ও আইনজীবী দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওই পুলিশ সদস্য আনিসুল হকের কাছে জানতে চান, ‘আপনি কোন ব্যক্তির কথা বলছেন?’

তখন চোখের ইশারায় উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে দেখিয়ে দেন আনিসুল হক। এর জবাবে ওই পুলিশ সদস্য আনিসুল হককে বলেন, ‘আপনি যাঁর কথা বলছেন, উনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা।’

এরপর আনিসুল হক ওই ব্যক্তির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।

আনিসুল হক গ্রেপ্তার হওয়ার ছয় মাস পেরিয়েছে। বেশ কয়েকটি হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলায় এখন পর্যন্ত তাঁর মোট ৪৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

 

ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে আজ বুধবার আদালতে হাজির করা হয়। সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণ, ঢাকা, ২৯ জানুয়ারি

ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামকে আজ বুধবার আদালতে হাজির করা হয়। সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণ, ঢাকা, ২৯ জানুয়ারি

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে শুনানি চলাকালে আনিসুল হককে হাসিমুখে সালমান এফ রহমানসহ অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। এর আগে তাঁকে কখনোই এত হাসি মুখে কথা বলতে দেখা যায়নি। বরং তিনি আদালতে আসামির কাঠগড়ায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। মাঝেমধ্যে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতেন। এর বাইরে তাঁকে অন্য আসামিদের সঙ্গে সেভাবে কথা বলতে দেখা যায়নি।

মোহাম্মদপুর থানার একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় আনিসুল হকের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ডের সপক্ষে পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার অন্যতম সহযোগী আনিসুল হক। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার মিটিং করেছিলেন আনিসুল হক। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আনিসুল হক জড়িত।

তবে আনিসুল হকের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন, কোনো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আনিসুল হক জড়িত নন।

অন্যদিকে মিরপুরের একটি হত্যা মামলায় সালমান এফ রহমানের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড আদেশ শোনার পর নির্বিকার ছিলেন তিনি।

আজ আনিসুল-সালমানসহ ১০ জনের রিমান্ড ও গ্রেপ্তার শুনানি শেষ হলে আবার তাঁদের কাঠগড়া থেকে নামিয়ে আদালতের হাজতখানায় নেওয়া হয়।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পতনের পর ১৩ আগস্ট প্রথম গ্রেপ্তার হন আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমান। প্রথম যেদিন তাঁদের আদালতে হাজির করা হয়, সেদিন তাঁদের লক্ষ্য করে ডিম ছুঁড়ে মারা হয়। তখন থেকে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে আদালতে বিমর্ষ দেখা যেত।

গত দুই সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকবার আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে আদালতে আনা হয়েছে। তাঁদের পক্ষে আইনজীবীরা আদালতে কথা বলেছেন। তাঁরা নিজেরাও আইনজীবীদের সঙ্গে নানা আইনি পরামর্শ করেছেন। আইনজীবীদের কাছ থেকে দেশের পরিস্থিতিও তাঁরা জেনেছেন।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আনিসুল হক, সালমান এফ রহমানসহ যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের আইনজীবীরা আদালতে কথা বলছেন। আইনি যুক্তিও তুলে ধরছেন।’


 

শেয়ার করুন