৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও ভারতের উদ্দেশে তাঁর যাত্রার আগে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানা না-ও যেতে পারে। তবে দৃশ্যত, এ ঘটনার আগে সেনাবাহিনী গণভবন অভিমুখে আসতে থাকা জনতাকে বাধা প্রদান বা জোরপূর্বক থামানোর চেষ্টা করেনি; যদিও প্রধানমন্ত্রী হয়তো সেটিই (সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ) চেয়েছিলেন। এ কারণে ও পরিবারের সদস্যদের চাপে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তাঁর জন্য দেশের বাইরে নিরাপদ স্থান খোঁজা ছাড়া আর বিকল্প পথ ছিল না। ২০০৬ সালের এপ্রিলে নেপালেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। তখন সাধারণ জনগণের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল দেশটির রাজকীয় সেনাবাহিনী। ফলস্বরূপ, রাজনৈতিকভাবে রাজাকে পরাজয়বরণ করতে ও চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়।
৫ আগস্টের পরিণতির পেছনে রয়েছে আরও কিছু কারণ। কার্যত কোনো বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেসব নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগও ছিল। এতে তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ একচেটিয়া বিজয়ী হয়। যদিও শেখ হাসিনা সরকার যৌক্তিকভাবেই এ দাবি করতে পারে যে চলতি বছরের নির্বাচন হয়েছে প্রচলিত আইন মেনে। কিন্তু বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের কারণে অনেকে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সরকারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছিল প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশেও পরিণত হতে চলেছে। দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ইতিমধ্যে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।
কিন্তু সরকারকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকুচিত করতে দেখা গেছে এবং বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যেখানে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ছিল উল্লেখ করার মতো। এ ছাড়া সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। কয়েক দিন ধরে হলেও পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, সরকার জনগণের সঙ্গে নিজের দূরত্ব সৃষ্টি করেছে।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা তাঁর পূর্বসূরি বেসামরিক সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হন। পূর্ববর্তী জোট সরকারে জামায়াত ছিল অংশীদার। ‘ইসলামি মৌলবাদের’ প্রতিও তৎকালীন সরকার নমনীয় ছিল। শেখ হাসিনার কৃতিত্ব তিনি ‘কট্টর ইসলামপন্থীদের’ তৎপরতা সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি উদারপন্থী ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বিরোধ এড়িয়ে চলছিলেন। এটি সম্ভবত খুব সতর্কতার সঙ্গে করা সম্ভব হচ্ছিল না; যা মানবাধিকার লঙ্ঘনে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে।
পরিহাসের বিষয়, ২০১৮ সালে সরকারের বাতিল করা কোটাপদ্ধতি হাইকোর্ট পুনর্বহাল করার পর গত জুন মাসে বর্তমান আন্দোলনটি শুরু হয়। বিষয়টি ছিল আদালতের বিচারাধীন। আন্দোলনের প্রাথমিক বিষয়টি ছিল, সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের ৩০ শতাংশ কোটা। পরে সুপ্রিম কোর্ট রায়ে এটি কমিয়ে ৫ শতাংশে আনেন।
জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে আদালত এ রায় দেন। কিন্তু অস্বস্তিকর পরিবেশের কারণে আন্দোলনের মূল বিষয় নিয়ে ক্ষোভের প্রশমন বা সমস্যার সমাধান হয়নি। সরকারের কিছু দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্যে তৈরি হওয়া এ পরিবেশে হারিয়ে যায় মূল বিষয়টি। শেখ হাসিনা বিক্ষোভকারীদের ‘রাজাকারের বংশোধরের’ সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে বক্তব্য দেন। রাজাকার শব্দ মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের সহায়তা করা ব্যক্তিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। শেখ হাসিনার ওই বক্তব্যে খেপে যান বিক্ষোভকারীরা। অথচ বিক্ষোভকারীরা মনে করেন, একটি ন্যায়সংগত কারণে আন্দোলন করছেন তাঁরা। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একজন মন্ত্রীর আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কর্মীদের লেলিয়ে দেওয়ার হুমকিও হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। দেশে সহিংসতায় এ পর্যন্ত চার শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন; যাঁদের বেশির ভাগই তরুণ।
দ্য ঢাকা ট্রিবিউন ঘটনার এ পর্বকে এভাবে তুলে ধরেছে, ‘এটি ছিল একটি ধীরগতির ট্র্যাজেডি (মর্মান্তিক ঘটনা)। এমন অনেক বিষয় ছিল, যা দিয়ে এ সংকট প্রশমিত বা সমাধান করা যেত। দুঃখজনকভাবে সেটি হয়নি; বরং ধীরে ধীরে পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরও খারাপ হতে থাকে। নিহতের সংখ্যা বেড়ে যায়, বৃদ্ধি পায় অস্থিরতাও। সঙ্গে যুক্ত হয় জনগণের ক্ষোভ ও অসন্তোষ। যেখান থেকে ফেরার আর পথ ছিল না।’
হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়ার পর থেকে দেশের বড় অংশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়। এর প্রাথমিক নিশানা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী ও সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। ছাত্রনেতারা এমনকি, জামায়াতে ইসলামীর আমিরও সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের রাষ্ট্রদূতেরাও হামলার ঘটনায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। শিক্ষার্থীরা ঢাকার মন্দিরগুলো পাহারা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু অপরাধী কারা, তা স্পষ্ট নয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ‘বিএনপি ও জামায়াতের সশস্ত্র নেতা–কর্মীদের’ নেতৃত্বে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা হয়েছিল।