বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন, তাঁদের অনেকেই ৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদের চেষ্টা করবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত স্বাধীন তদন্ত কমিশন। সেটি সম্ভব না হলে ওই দেশে গিয়ে তাঁদের (যাঁরা পালিয়েছেন) বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হবে। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে কমিশন নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে কাজ করে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চিহ্নিত করবে এবং দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে মতামত দেবে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরে তদন্ত কমিশনের প্রথম বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেছেন কমিশনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এটা (তদন্ত কমিশন) কিন্তু অন্য কমিশনের মতো নয়। এটা অন্য রকম কমিশন, যেখানে দেশি-বিদেশি শক্তি ও ষড়যন্ত্রকে চিহ্নিত করতে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো দেশকে আইডেনটিফাই (চিহ্নিত) করতে চাই না। নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে আমরা অগ্রসর হতে চাই। সেটা করতে গিয়ে যাঁরা দালিলিকভাবে, সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্সের (পারিপার্শ্বিক প্রমাণ) ভিত্তিতে দায়ী হবেন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেভাবে ঘটনা এসেছে, সেভাবে মতামত দেব। দেশি–বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা যেহেতু বলা হয়েছে, তাতে আমাদের দেশের অনেকেই হয়তো এই কমিশনের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হবে। এসব ব্যক্তি ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর দেশ থেকে চলে গেছেন। তাঁরা কোথায় আছেন, কোন দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, এসব দেশের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করব। প্রয়োজন হলে আমরা ওই দেশের সঙ্গে আলোচনা করে যাঁদের ফেরানো না যায়, তাঁদের বক্তব্য নিতে সে দেশে টিম পাঠাব।’
এই কমিশনের সভাপতির মর্যাদা সরকারের একজন উপদেষ্টার সমমানের হতে হবে জানিয়ে তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমি বলেছি, এই কমিশনের যিনি সভাপতি, তাঁর মর্যাদা হতে হবে একজন অ্যাডভাইজারের (উপদেষ্টা) সমান। কারণ, আমাদের ডিল করতে হবে দেশি-বিদেশি মানুষের সঙ্গে। কাজেই সমমর্যাদায় থেকে যেন আমরা ডিল করতে পারি। যাঁরা সদস্য (কমিশনের) রয়েছেন, তাঁদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতির মর্যাদায় অভিষিক্ত করার আবেদন জানাব। এগুলো হওয়ার পরেই পরবর্তী বৈঠক (কমিশনের) করা হবে। সেদিনই বক্তব্য নেওয়া শুরু হবে।’
আজ বৃহস্পতিবার সকালে পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরে তদন্ত কমিশনের প্রথম বৈঠক হয়ছবি: বিজিবির সৌজন্যে
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে গঠিত স্বাধীন কমিশন কোনো কিছুতেই প্রভাবিত হবে না উল্লেখ করে তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের বুদ্ধি, বিবেচনা, প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করে নিরপেক্ষভাবে আমরা এই তদন্ত নির্ধারিত সময়ে শেষ করার ঐকান্তিক চেষ্টা করব। এই কমিশন কোনো কিছু দ্বারা প্রভাবিত হবে না, এটার নিশ্চয়তা আমি আপনাদের দিতে পারি। বিডিআর বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে যাঁরা নিগৃহীত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন, বঞ্চিত হয়েছেন—সবকিছু আমরা নজরে নেব। আমাদের কাজ শেষ হওয়ার পর যেন প্রশ্ন না ওঠে, আমরা কাজ সম্পন্ন করতে পারিনি।’
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার চলছে, এর মধ্যে আবার তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। এখানে বিষয়টি সমন্বয় হবে কীভাবে—এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনে চেয়ারম্যান বলেন, এ জন্য কমিশনে দেশের দুজন ও আন্তর্জাতিক মানের দুজন বিদেশি আইনজ্ঞ সম্পৃক্ত করতে বলা হয়েছে। এসব বিশেষজ্ঞ আইনজীবী অন্তর্ভুক্ত করতে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হবে।
বিজিবির সাবেক এক মহাপরিচালককে দেশত্যাগে বাধা দেওয়া হয়েছে, যিনি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তদন্ত কমিশন কারও দেশত্যাগে বিধিনিষেধ আরোপ করছে কি না—এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, ‘এটা নিয়ে আলোচনা করব। যদি আমরা মনে করি, তদন্তের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে কারও দেশে অবস্থান করা প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
কমিশনের প্রথম বৈঠকের আলোচনা প্রসঙ্গে ফজলুর রহমান বলেন, কমিশন কীভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হবে, সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কাজের সুবিধার্থে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কমিশনকে কিছু চিঠি লিখতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বরাবরও চিঠি লেখা হবে। কমিশনকে সাচিবিক সুবিধা দিতে হবে। কার্যালয় দিতে হবে। এসব চিঠি লেখার পরই কমিশন কাজ শুরু করবে।
কমিশনের বক্তব্য গণমাধ্যমে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার অনুরোধ জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হলে যে উদ্দেশ্যে কমিশন করা হয়েছে, সেটি ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) সদর দপ্তর পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে ১৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। মইন ইউ আহমেদ পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সময় সেনাপ্রধান ছিলেন।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসহ বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে। এমন প্রেক্ষাপটে ১৭ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তাঁর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছিলেন। পরে গত সোমবার তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে কমিটি নয়, সরকার কমিশন গঠন করেছে।