বিমা কোম্পানির গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের অর্থ লেনদেনসহ একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন সচিব আসাদুল ইসলামকে চিঠি দেয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের কাছেও পাঠানো হয় সেই চিঠির অনুলিপি।
তখন বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান ছিলেন শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, যিনি একসময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ছিলেন। তাঁর বিশেষ আগ্রহে এরপর ইউনিফায়েড মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম (ইউএমপি) নামের একটি উদ্যোগ দাঁড় করানো হয়। আর কোনো ধরনের উন্মুক্ত দরপত্র না ডেকেই এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য বেছে নেওয়া হয় দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিকে। দুয়ার প্রিমিয়াম প্রতি ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ১০ টাকা করে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তা দর-কষাকষি করে পরে ৮ টাকায় নামিয়ে আনে আইডিআরএ। আরও পরে এ হার কমে আসে ৩ টাকা ৯০ পয়সায়। এর বাইরে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যাচাই করার জন্যও ১ টাকা করে পাচ্ছে দুয়ার।
দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিকে কাজ দেয় আইডিআরএ। সংস্থাটি এ জন্য কোনো দরপত্র আহ্বান করেনি।
এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি বিমা কোম্পানিগুলোর মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। শফিকুর রহমান পাটোয়ারী তখন একই বছরের ২১ নভেম্বর তিন পৃষ্ঠার একটি চিঠি দেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। মুস্তফা কামালও তাতে অনুমোদন দেন। অনুমোদনের আগেই এটি চালু হয়। তবে ২০২০ সালের শুরুর দিকেই পুরোদমে চালু হয়ে যায় ইউএমপি।
আইডিআরএর সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু আইডিআরএর পকেট থেকে টাকা খরচ হবে না, তাই উন্মুক্ত দরপত্রে যাওয়া হয়নি।’
কিন্তু উন্মুক্ত দরপত্র ডাকা হলে তো আরও কম টাকায় একই সেবা পাওয়া যেতে পারত। তা ছাড়া সরকারের একটি বিশেষ সংস্থাকে কীভাবে এতে জড়িত হতে দিলেন, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শফিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, বিশেষ সংস্থা তো সব সময়ই থাকে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে বিমা খাতের অর্থ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে ওই সংস্থা চিঠি দিয়েছিল।
বিআইএর সঙ্গে আমরা সোমবার (আজ) বসছি। অনেক আলোচ্যসূচির মধ্যে এ ব্যাপারেও তাদের কথা শুনব। পরে দুয়ারের কথাও শুনব। এরপর দেখা যাবে কী করা যায়।
এম আসলাম আলম, চেয়ারম্যান, আইডিআরএ
বিমা খাতে রাষ্ট্রীয় সংস্থা রয়েছে দুটি, সাধারণ বীমা করপোরেশন ও জীবন বীমা করপোরেশন। আছে বিদেশি মেটলাইফ ও এলআইসি। এর বাইরে বেসরকারি জীবন বিমা ও সাধারণ বিমা (নন লাইফ) কোম্পানি রয়েছে ৭৯টি। সব মিলিয়ে ৮৩টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বছরে প্রায় এক কোটি পলিসি হয়। এসব পলিসির আওতায় খুদে বার্তাসহ আরও কিছু সেবা বাবদ ১০০ কোটি টাকার কাছাকাছি চলে গেছে দুয়ার সার্ভিসেসের কাছে। পে-অর্ডারের মাধ্যমে মাসের ১ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে আইডিআরএকে এ অর্থ দিতে হয়। আইডিআরএ পরে তা দেয় দুয়ার সার্ভিসেসকে।
যোগাযোগ করলে আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিআইএর সঙ্গে আমরা সোমবার (আজ) বসছি। অনেক আলোচ্যসূচির মধ্যে এ ব্যাপারেও তাদের কথা শুনব। পরে দুয়ারের কথাও শুনব। এরপর দেখা যাবে কী করা যায়।’
বেসরকারি কোম্পানিগুলো বলছে, তারা নিজেরাই খুদে বার্তা দিয়ে আসছিল গ্রাহকদের। এতে খরচ হচ্ছিল বছরে ৬ টাকার সামান্য বেশি। অথচ দ্বিগুণের বেশি দামে তৃতীয় পক্ষের একটি কোম্পানিকে তাদের তথ্য দিতে হচ্ছে। অথচ বিশেষ কোনো ঘটনার তদন্তের কারণ ছাড়া বিমা আইনে গ্রাহকের কোনো তথ্য তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার বিধান নেই।
ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকদের খুদে বার্তা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তো কোনো খরচ নেয় না। আর আমরাই গ্রাহকদের খুদে বার্তা দিচ্ছি এবং দিয়ে যাব।
নাসির উদ্দিন আহমেদ, সভাপতি, বিআইএ
আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কিছু কোম্পানি পলিসি গ্রাহকদের কোনো তথ্য পাঠাচ্ছে না আইডিআরএর কাছে। সে দিক থেকে আইডিআরএর কাছে চলতি বছরের গ্রাহকদের প্রিমিয়ামের অর্থের পুরোপুরি তথ্যভান্ডার নেই।
দুয়ার সার্ভিসেসের এমডি সৈয়দ আহমদ রসুল বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ভুল প্রচারণা আছে। শুধু খুদে বার্তার জন্য এত টাকা নেওয়া হয় না। ইউএমপির আওতায় অন্তত ১০টি সেবা রয়েছে।’
এদিকে বিআইএ সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউএমপি সেবার বিনিময়ে কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা টাকা নিতে পারে কি না, এটা আমার বড় প্রশ্ন। ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকদের খুদে বার্তা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তো কোনো খরচ নেয় না। আর আমরাই গ্রাহকদের খুদে বার্তা দিচ্ছি এবং দিয়ে যাব।’