বাংলা সাহিত্যের এক শিক্ষিকার কথা বলি। ক্লাসেই তিনি গল্পটি করেছিলেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ধরুন, তাঁর নাম সাদিয়া আহমেদ। তো সাদিয়া শাড়ি সংগ্রহ করতে খুব পছন্দ করেন। ছুটির দিনে বাজার ঘুরে ঘুরে শাড়ি কেনা তাঁর নেশা। যেখানেই ঘুরতে যান, ফিরে আসার সময় সঙ্গে থাকে প্যাকেটে মোড়া নতুন শাড়ি। ক্লাসে কেউ কোনো দিন তাঁকে এক শাড়ি দুবার পরতে দেখেনি। কয়েকবার এমনও হয়েছে, শাড়ি কিনে বাড়ি ফিরে দেখেছেন, সেই শাড়ি তাঁর আগেই কেনা ছিল! ২০০৭ সালের নভেম্বরে সিডরে তাঁর শাড়ির সংগ্রহের একাংশ পানিতে ভেসে যায়, বেশ কিছু শাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। নতুন পোশাক কেনা অনেকেরই ‘নির্দোষ’ শখ। তবে সাদা চোখে সেটিকে যতটা ‘নির্দোষ’ দেখায়, বাস্তবতা তা নয়। অতিরিক্ত পোশাক কেনা অপচয় নিঃসন্দেহে। কেবল অর্থের অপচয় নয়। পোশাকের কাঁচামাল আসে মূলত পরিবেশ থেকে। ফলে এক অর্থে তা পরিবেশেরও ক্ষতি। অর্থাৎ আমরা গাছের যে ডালে বসে আছি, সে ডালই কেটে নিজেদের ধ্বংসই ডেকে আনছি।
ইনস্টাগ্রামে ওয়াশিংটন পোস্টের একটা পোস্টে চোখ আটকে যাওয়ায় ঘটনাটা মনে পড়ল। ‘নতুন পোশাক কেনা বন্ধ করুন’ পরামর্শ দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতিবছর গড়ে ৯২ মিলিয়ন টন কাপড় ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। ৬০ বিলিয়ন বা ৬ হাজার কোটি পোশাক স্রেফ নষ্ট হয়। আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এর ৭৩ শতাংশই প্রি–কনজিউমার ওয়েস্ট। মানে ওই পোশাকগুলো ভোক্তারা কেনেননি বা কিনলেও ব্যবহার করেননি। ২০৩০ সালের মধ্যে এই ‘টেক্সটাইল ওয়েস্ট’-এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ১৩৪ মিলিয়ন টন!
প্রতিবছর ৮ বিলিয়ন মানুষের জন্য নতুন করে ১০০ বিলিয়ন পোশাক উৎপন্ন হয়! তার মানে বিশ্বে যত মানুষ আছে, তাঁরা প্রত্যেকে প্রতিবছর গড়ে কমপক্ষে ১২টি করে নতুন উৎপাদিত পোশাক কেনে, কিন্তু সেটা সত্যি নয়। ৬০ বিলিয়ন পোশাক কখনোই বিক্রি হয় না। প্রতি সেকেন্ডে বস্তা বস্তা পোশাক ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
এটি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। এর একটা বড় অংশ কখনো বিক্রিই হয় না। গড়ে পাঁচটি উৎপাদিত পোশাকের মাত্র দুটি বিক্রি হয়। তিনটি থাকে অবিক্রীত! আর এসব অবিক্রীত পোশাক ফেলে দেওয়া হয়। এসব পোশাকে যে ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়, তাতে থাকে পরিবেশের জন্য, বিশেষ করে মাটির জন্য ক্ষতিকর ‘মাইক্রো পার্টিকেলস’, যা মাটিকে অনুর্বর করে তোলে। বর্জ্য হয়ে পরিবেশকে করে তোলে বসবাসের অনুপোযোগী। এসব পোশাক উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে শক্তি আর প্রকৃতির নানা উপাদানও ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটা সুতির টি-শার্ট বানাতে যে পরিমাণ কাপড় লাগে, সেটির জন্য প্রয়োজনীয় তুলা উৎপাদন করতে ২০ হাজার লিটার পানি খরচ হয়। বিশ্বে যত পানি ব্যবহৃত হয়, তার ২০ শতাংশ খরচ হয়ে যায় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। এর সঙ্গে থাকে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম শক্তির ব্যবহার। মোটকথা, পোশাকসংশ্লিষ্ট এসব বর্জ্য বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ, পানিদূষণ করে নানাভাবে পরিবেশদূষণ করছে। ওয়ার্ল্ডওয়াইড রেসপনসিবল অ্যাক্রিডিটেড প্রোডাকশন (ডব্লিউআরএপি) জানাচ্ছে, প্রতিবছর যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকার জামাকাপড় ফেলে দেওয়া হয়! এটা তো কেবল আর্থিক ক্ষতির হিসাব। কিন্তু প্রাকৃতিক শক্তি আর সম্পদ কী পরিমাণ অপচয় হলো, প্রকৃতি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তার কোনো খতিয়ান নেই। সম্পদের কী নিদারুণ অপচয়!
ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) গবেষণামতে, প্রতিবছর পোশাকশিল্প কারখানায় পোশাক ও তুলা ধোয়া ও রং করার কাজে ১ হাজার ৫০০ বিলিয়ন লিটার পানি ব্যবহার করা হয়। কারখানাগুলো ব্যবহারের পর এই বিষাক্ত পানি নদী আর খালে ফেলে দেওয়া হয়। ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ফ্যাশনশিল্পের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস ও বর্জ্য নিঃসরণ বৃদ্ধি পাবে ৬০ শতাংশ। ২০৫০ সালের মধ্যে ভোক্তার চাহিদা মেটাতে বর্তমানে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, তার তিন গুণ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়োজন হবে। এই নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনার অন্যতম সমাধানের নাম টেকসই ফ্যাশনশিল্প।
ফাস্ট ফ্যাশনের ফ্যালাসিতে বুঁদ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিছবি: প্রথম আলো
পোশাকের ‘গড় আয়ু’ বৃদ্ধি করার কোনো বিকল্প নেই। একটি পোশাকের সর্বোচ্চ জীবনকাল গড়ে তিন বছর। পোশাক পুরোনো মলিন হয়ে যায়, ছিঁড়ে যায়। চলতি ট্রেন্ডের সঙ্গে যায় না। আপনি যদি একটা পোশাক ৯ মাসের বেশি পরেন, তাহলে ওই পোশাক উৎপাদনজনিত কার্বন নিঃসরণ এবং ওই পোশাকের পেছনে ব্যবহৃত পানির অপচয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। তাই আলমারি আর ওয়ার্ডরোব ঘেঁটে পুরোনো পোশাকই বের করে নতুন করে পরুন। আপসাইকেল, রিসাইকেল করে পরুন। পোশাকের জীবনচক্র ধীর আর লম্বা করুন।
ইনস্টাগ্রামে তারকা ও মডেলদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে অতিরিক্ত পোশাক কেনার কোনো মানে নেই। আম্বানি বাড়ির বিয়ে-উৎসবে তাঁদের পোশাক দেখে জমানো টাকা ভেঙে অতিরিক্ত পোশাক কিনলেন মানেই অপচয় করলেন—নিজের অর্থ আর প্রাকৃতিক সম্পদ দুটোই। যে বিশ্বে সম্পদের কোনো সুষম বণ্টন নেই, শিশুরা খাবারের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ভোগে, শীতে ঠান্ডায় ঘুমাতে পারে না বৃদ্ধ, সেই বিশ্বে অতিরিক্ত পোশাক কিনে অপচয় করলেন মানে মানবসভ্যতার কাছে আপনি অপরাধী হয়ে থাকলেন।
তাই পৃথিবীকে রক্ষার তাগিদে হলেও আমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পোশাক কিনে অপচয় বন্ধ করতে হবে। ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ রুখে দিতে না পারলে নিজেদের সর্বনাশ ঘনিয়ে আসবে আরও দ্রুতগতিতে। তাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে প্রয়োজনের বাইরে নতুন পোশাক কেনা বন্ধ করুন।