মো. রাকিব উদ্দীন একজন উদ্যোক্তা ও পূর্ণকালীন ফ্রিল্যান্সার। রাকিবের বাবা মো. আবু নাসের একজন ব্যবসায়ী, মা সেলিনা নাসের গৃহিণী। স্ত্রী নাজমুন নাহারও গৃহিণী। মা-বাবা, স্ত্রী এবং দুই বছরের সন্তান মো. আরহাম উদ্দীনকে নিয়ে তাঁর পরিবার। এই পরিবারের জন্যই বিদেশে উচ্চতর জীবনের হাতছানি থাকা সত্ত্বেও দেশ ছাড়েননি তিনি। নিজের অধ্যবসায় ও স্পৃহার কারণে আজ দেশে বসেই তিনি মাসে ৭ থেকে ১০ লাখ টাকা আয় করেন ফ্রিল্যান্সিং করে।
ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন রাকিব। ২০০৫ সালে কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৭ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। খুব ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে কম্পিউটার প্রকৌশলী হওয়ার। সেই লক্ষ্যে ভর্তি হন চট্টগ্রাম প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে। ২০১২ সালে পাস করেন।
বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাঠাবেন ছেলেকে। রাকিব প্রস্তুতি শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে যাওয়ার সুযোগও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু রাকিবের বাবা ছিলেন প্রবাসে। এ ছাড়া লেখাপড়ার জন্য দীর্ঘ সময় বাবা-মা থেকে দূরে থাকতে হয় রাকিবকে। তাই তাঁর ইচ্ছা ছিল এমন কিছু একটা করার, যা তাঁকে গ্রামে গিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকার সুযোগ করে দিতে পারে। মূলত এ কারণেই আর বিদেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি তাঁর। শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়েননি তিনি। ২০১৬ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি সম্পন্ন করেন রাকিব। শিক্ষকতাকে তিনি শুধু পেশা হিসেবেই নেননি, এটি ছিল তাঁর নেশাও। তাই মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে থাকেন। তবে গ্রামে গিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকার আজন্ম ইচ্ছাটা তখনো জীবিত। ভাবছিলেন, নতুন কিছু করতে হবে, ব্যতিক্রম কিছু। বেশি কিছু চিন্তা না করেই অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং দেওয়ার ওয়েবসাইট ফাইভআর মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট খোলেন।
২০২১ সাল থেকে শুরু হয় রাকিবের নতুন পথচলা। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম এক হাজার ডলারের বেশি আয় করেন। এটাই ছিল ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রথম সফলতা। তবে এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ফাইভআরে তাঁর প্রোফাইল খুব দ্রুত ভারী হতে থাকে। সমান্তরালে বাড়তে থাকে আয়।
কিছুদিনের মধ্যে ফাইবার মার্কেটপ্লেসে টপ রেটেড সেলার হয়ে যান রাকিব। এখানে তিনি মূলত কোর্স ক্রিয়েশন, বুক রাইটিং, আর্টিকেল রাইটিংয়ের কাজ করেন। ইতিমধ্যে ১০০০-এর ওপরে প্রকল্প করেছেন সব মিলিয়ে।
কঠোর পরিশ্রম এবং মা-বাবার দোয়া ও উৎসাহ তাঁকে আরও সামনে এগিয়ে নেয়। একসময় ১২-১৫ জনকে নিয়ে একটি দল বানিয়ে ফেলেন। একসঙ্গে কাজ শুরু করেন। কাজের পরিধি আরও বাড়ে। কাজ শুরু করেন আমাজন হোলসেলার হিসেবেও। সেখানেও একটা দল করে নেন।
মো. রাকিব উদ্দীনশুভ্র কান্তি দাশ
রাকিবের সঙ্গে গল্পে গল্পে শুরুর দিনের একটি ঘটনা তিনি প্রথম আলোকে বলেন। ‘আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম, তখন একটা ছেলে প্রায়ই আমার ক্লাসে দেরি করে আসত। আমি তাকে খুব বকঝকা করতাম। একদিন ছেলেটিকে বললাম, এই তুমি এত দেরি করে আসো কেন? সমস্যা কী তোমার। তখন ছেলেটি আমাকে জানাল ফাইভআরের কথা। বলল, “স্যার, আমার সকালে একটু ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়, তাই দেরি করে আসি। কারণ, আমি মার্কেটপ্লেস ফাইভআরে কাজ করি। স্যার, মাসে এক লাখ টাকা আয়ও হচ্ছে।” ছেলিটির কথা শুনে আমার একটু খারপই লাগল ওরে আমি কত বকাঝকা করেছি। ও তো আসলে পাড়াশোনার পাশাপাশি কাজও করছে। আমি বাসায় এসে ফাইভআর মাকেটপ্লেসে ঢুকলাম। দেখলাম, এখানে কাজ জানা থাকলে বা দক্ষ হলে কাজ করার সুযোগ আছে। তাই মাঝেমধ্যে বলি, সবার কাছ থেকেই শিক্ষা নেওয়া যায়।’
২০২৩ সালের জুলাইয়ে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে রাকিব বাবা-মায়ের কাছে রাজবাড়ীর শ্রীপুরে চলে যান। সেখানে গিয়ে পুরোপুরি ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে মনোযোগ দেন। অন্য অনেক বাঙালির মতো তিনিও স্বপ্ন দেখতেন বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াবেন, পরিবারের হাল ধরবেন। অবশেষে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়।
শিক্ষকতা ছিল রাকিবের ধ্যানজ্ঞান। তাই এই পেশা ছেড়ে দিলেও সব সময় চেয়েছেন জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে। অনলাইন তাঁর সামনে অপার সম্ভাবনা নিয়ে আসে। তিনি পরিবারের বাইরে গিয়ে কিছু একটা করার তাড়না অনুভব করেন, যেখানে বদলে দেওয়া যেতে পারে হাজারো জীবন। সেই লক্ষ্যে দুই কাছের মানুষকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন স্কিল-স্কুল নামের প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রতিষ্ঠান। তিনজন মিলে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং ও স্পোকেন ইংলিশ কোর্স।
সেই শিক্ষকতাতেই ফিরে এলেন, তবে একটু ভিন্ন রূপে। অতি সাধারণ মানুষের জীবন পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। চাকরি না করেও যে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়, পরিবার ও সমাজে অবদান রাখা যায়, সেটা শেখাতে শুরু করলেন। এখন রাকিবের সব লক্ষ্য স্কিল-স্কুলকে নিয়ে। প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তিনি। অনেক বড় করতে চান।
রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যতটুকু অর্জন, আমার শিক্ষা—এর সবটুকুর জন্য আমি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। জন্মের পর থেকে আমি আমার মা-বাবাকে অনুসরণ করে পর্যন্ত এসেছি। তাঁরা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। আমার লক্ষ্য, তাঁদের সাথে থেকে, আমাদের স্কিল-স্কুলকে অসীম সফলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার। এমন হাজারো সফলতার গল্প তৈরি করতে চাই আমি।’