পুরোনো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা সদরের ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে চম্পকনগর। এখান থেকে অটোরিকশায় এক কিলোমিটার পাড়ি দিলেই জগন্নাথ সোনাপুর গ্রাম। পাখির কলতানে মুখর সবুজ–শ্যামল গ্রামের বড় এক দিঘির পাড়ে ছোট একটা ঢিবি। তার গায়ে মাটি কেটে বানানো একটা সুড়ঙ্গের মুখ। উঁকি দিলে অপর প্রান্ত দেখা যায় না। নিরিবিলি পাড়াগাঁয়ে এমন সুড়ঙ্গ কে তৈরি করেছে, এটা ভেবে বিস্মিত হবেন নতুন কেউ। এলাকার লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ। কে ছিলেন শমসের গাজী, কেনই–বা এমন সুড়ঙ্গ নির্মাণ—এমন প্রশ্নের উত্তরে গ্রামের কেউ বলতেই পারেন, সে এক বিরাট ইতিহাস।
ছাগলনাইয়ার চম্পকনগরের শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ দেশের তালিকাভুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ভাটির বাঘ নামে পরিচিত শমসের গাজী একসময় এ এলাকা শাসন করতেন। এখানে তিনি তৈরি করেছিলেন সুবিশাল কেল্লা, সুড়ঙ্গ আর দিঘি। প্রায় ১৫ একর জায়গায় আজও ছড়িয়ে আছে সেসব নিদর্শন।
সেখানে অন্তত দুটি টিনের জীর্ণ ফলকে শমসের গাজীর স্থাপনার কথা উল্লেখ আছে। এর একটি স্থানীয় লোকজনের দেওয়া, অন্যটি বিজিবির। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় নিদর্শন দেখতে গিয়ে কেউ যেন সীমানাখুঁটি অতিক্রম না করেন, সে জন্য সতর্ক করে বিজিবি সাইনবোর্ড দিয়েছে সেখানে।
কেন এই সুড়ঙ্গ নির্মাণ করা হয়েছে, জানতে চাইলে গ্রামের বাসিন্দাদের কেউ বলেন, আক্রমণকারী শত্রুপক্ষের যোদ্ধাদের ঠেকাতে। আবার কেউ বলেন, বাড়ির নারীদের গোসলের জন্য পুকুরে যাওয়ার পথ ছিল এটি। সুড়ঙ্গটি নির্মাণের সময় এর দৈর্ঘ্য ৪০-৪৫ মিটার ছিল বলে দাবি করেন অনেকে। সে সময় এটির একটি মুখ ছিল চম্পকনগর গ্রামে, অন্য প্রান্তে ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার আমলি ঘাট। তবে মাঝখানের অনেক স্থানে ধসে যাওয়ায় এখন আর ভারতের সঙ্গে সুড়ঙ্গটির সংযোগ নেই। শুধু এ সুড়ঙ্গ নয়, শমসের গাজীর খনন করা বিশাল খুইল্লার দিঘি আর কেল্লার ভিটা রয়ে গেছে আজও।
কে ছিলেন ‘ভাটির বাঘ’ শমসের গাজী
মনোহর শেখের ‘গাজী নামা’, আহমদ মমতাজের ‘শমসের গাজী’ বই ও বিভিন্ন লেখা ঘেঁটে জানা গেছে, ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ–পূর্ব বাংলায় কৃষক ও প্রজাদরদি এক বিপ্লবী শাসক। বৃহত্তর নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের কিছু অংশ ছিল তাঁর শাসনাধীন।
শমসের গাজীর জন্মসাল নিয়ে নানা মতভেদ আছে। কেউ বলেন ১৭০৫ বা ১৭০৬ সালে তাঁর জন্ম। আবার কারও মতে, ১৭১২ সালে বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার গোপাল ইউনিয়নের নিজকুঞ্জরা গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। পিতা পীর মোহাম্মদ তখনকার ওমরাবাদ পরগনার একটি কাছারিতে খাজনা আদায় করতেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল কৈয়ারা বেগম। শৈশবে বাবা মারা গেলে শুভপুরের তালুকদার জগন্নাথ সেনের বাড়িতে পুত্রস্নেহে বড় হন তিনি। সেখানেই তির-ধনুক, তলোয়ার চালানোসহ সমরবিদ্যায় পারদর্শী হন। এরপর দিকে দিকে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে শমসের গাজীর।
শমসের গাজীর খনন করা দিঘি
সাহসী শমসের গাজী এলাকার কৃষকদের সংগঠিত করেছিলেন। বিদ্রোহ করেছিলেন ত্রিপুরার রাজা কৃষ্ণ মাণিক্যের বিরুদ্ধে। এক যুদ্ধে কৃষ্ণ মাণিক্যের উজির জয়দেবকে বন্দী করেন তিনি। পরে জয়দেবকে মুক্তি দেওয়ার শর্তে তিনি ত্রিপুরা রাজার কাছ থেকে একটি জমিদারি লিখে নেন। ত্রিপুরার রাজার বিরুদ্ধে অবস্থান শক্ত করার পেছনে ছিল কৃষকদের সমর্থন। শমসের গাজী প্রতাপশালী শাসকের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে একসময় কৃষকদের নেতা হয়ে ওঠেন। সিলেটের মনু নদ পর্যন্ত বিশাল এলাকা তাঁর প্রভাববলয়ে চলে আসে।
শাসনকালে কৃষকদের খাজনা মওকুফ, জনহিতকর কাজ, একই সঙ্গে তাঁর ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব ইংরেজদের কাছে শমসের গাজীকে শত্রু করে তোলে। পরে ইংরেজরা ত্রিপুরা রাজার সমর্থনে সুদক্ষ সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে শমসের গাজীকে পরাস্ত করেন। ধারণা করা হয়, ১৭৬০ বা ১৭৬১ সালে কোনো এক সময় শমসের গাজীর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু জানা যায় না। তবে ভাটির বাঘ পরিচয়ে তিনি আজও বেঁচে আছেন কৃষকের মনে।
যেভাবে যাবেন
শমসের গাজীর রহস্যময় সুড়ঙ্গ, দিঘি ও তাঁর শাসনামলের স্মৃতিবিজড়িত জগন্নাথ সোনাপুর গ্রামে যেতে হলে প্রথমে আসতে হবে ফেনী শহরে। সেখান থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে যেতে হবে ছাগলনাইয়া উপজেলা সদরে। সেখান থেকে পুরোনো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই চম্পকনগর। চম্পকনগর থেকে রিকশা বা অটোতে গাজীর স্মৃতিবিজড়িত জগন্নাথ সোনাপুর গ্রামের দূরত্ব সময়ের হিসাবে মিনিট দশেক। আশপাশে থাকার ব্যবস্থা না থাকায় দিনে দিনেই ঘুরে যেতে হবে ইতিহাসখ্যাত শমসের গাজীর স্মৃতিবিজড়িত এ স্থান।