বার্লিন প্রাচীর ভাঙার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত জমানার সমাপ্তি হলো। সেই সময় থেকে শুরু করে ওয়াশিংটনের বর্তমান কূটনৈতিক দপ্তরগুলো একটা ভুল ধারণা নিয়ে রয়ে গেছে। আর তা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বর্তমান প্রতিযোগিতা পুরোনো সোভিয়েত যুগের মতোই এক ঠান্ডা যুদ্ধের ছকে চলবে।
এই ধারণা পুরোনো ছকের সঙ্গে মেলে। ফলে পরিকল্পনা করতে সুবিধা হয়। ভাবা হয় যে আগের মতো করে প্রতিপক্ষকে আটকে রাখা যাবে, জোটগুলোকে শক্ত করে ব্লকে বাঁধা যাবে আর শেষ পর্যন্ত জয় আসবে মতাদর্শগত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চীন আর সোভিয়েত ইউনিয়ন এক নয়।
চীন বিচ্ছিন্ন কোনো সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নয়। বা অতিরিক্ত সামরিক ব্যয়ের চাপে জর্জরিত কোনো সাম্রাজ্য নয়। চীন একটি বিশ্বায়িত, প্রযুক্তিচালিত, সভ্যতাভিত্তিক রাষ্ট্র। চীনের আছে অর্থনৈতিক শক্তি, দক্ষ প্রশাসন এবং সাফল্যের ধারাবাহিকতা। চীন বিশ্বরাজনীতিতে মস্কোর মতো কোনো ভূমিকা নিতে রাজি নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত নীতিতে ঠান্ডা যুদ্ধের চেয়ে আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা এত গভীর ছাপ ফেলেনি। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কিন্তু সোভিয়েত মডেল অন্তত শেষের দিকে ছিল ভঙ্গুর। বাইরে থেকে একে পরাশক্তি মনে হলেও ভেতরে তার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল কঠোর ও কর্তৃত্ববাদী।
সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। প্রযুক্তির দিক থেকেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল অনেক পিছিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা বিশ্ব যখন লাখ লাখ কম্পিউটার বানাচ্ছিল, সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন উৎপাদন করত মাত্র কয়েক হাজার।
সোভিয়েত জোট ছিল জবরদস্তিমূলক, উদ্ভাবনে পিছিয়ে এবং শিল্পকাঠামো ছিল আত্মবিরোধে ভরা। ১৯৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে, তখন যুক্তরাষ্ট্র শুধু সামরিকভাবে নয়, কৌশলগত চিন্তাভাবনাতেও বিজয়ী মনে করেছিল নিজেকে। বিশ্বরাজনীতিতে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে আমেরিকা তৈরি করেছিল এক নতুন রেসিপি। ঘেরাও, প্রতিরোধ, মতাদর্শ প্রচার এবং ধ্বংসের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করা।
আজ মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা সেই পুরোনো ফর্মুলাই চীনের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে চাইছেন। কিন্তু এবার প্রতিপক্ষ সেই আগের মতো নয়। চীন কোনো দুর্বল আদর্শিক জোট নয়। সে বরং একটি টেকসই রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেখানে প্রযুক্তি, পুঁজিবাদ এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ একসঙ্গে কাজ করছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিমা অর্থনীতি থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন ছিল। আর চীন এখন সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করছে।
চীনের উত্থান কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এটা একধরনের ফিরে আসা বলতে পারেন। ইতিহাসের অনেকটা সময়জুড়ে চীনই ছিল বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ১৮২০ সালে চীনের হাতে ছিল বিশ্ব অর্থনীতির ৩০ শতাংশের বেশি। এরপর ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের হাতে তার শতাব্দীকাল অপমানের ভেতর কেটেছে। সেই অপমানের স্মৃতি এখনো চীনের জাতীয় মননে গভীরভাবে আঁকা আছে।
১৯৭৮ সালে দেং শিয়াও পিংয়ের নেতৃত্বে ‘সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ’ নীতি চালু হয়েছে ঠিকই কিন্তু চীন কখনো তার অর্থনীতিকে পশ্চিমা শর্তে পুরোপুরি উন্মুক্ত করেনি। ২০০১ সালে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় যোগ দিলেও, বেইজিং তার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বিদেশি পুঁজির হাতে তুলে দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের বরং এখন নিজের দিকে ফিরে তাকানো দরকার। তার উচিত এই বৈশ্বিক পরিবর্তনের সময়টিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শিল্প ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা পুনর্গঠন করা। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যেমন চীন-ভারত সংঘাত, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে আসিয়ানের দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধ কিংবা বেইজিংয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা নিয়ে আঞ্চলিক উদ্বেগ—এসবকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকার নতুন কৌশল সাজানো দরকার।
চীনকে ঠান্ডা যুদ্ধের ছকে ঘেরাও করার মার্কিন কৌশল শুধু ভুল নয়, বিপজ্জনকও বটে। এই কৌশলের পেছনে একটা ধারণা কাজ করছে। আর তা হলো প্রতিপক্ষ একদিন নিজের ভেতরের সমস্যায় নিজেই ধসে পড়বে। আর তার জন্য প্রয়োজন হবে বিশ্বজুড়ে ছড়ানো ও বিপুল ব্যয়ে পরিচালিত কৌশল।
কিন্তু আজকের বাস্তবতা আলাদা। যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ১৯৫০ সালের মতো কোনো শিল্পের দিক দিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র নয়। আমেরিকার অর্থনীতি এখন অনেকটাই পোস্ট-ইন্ডাস্ট্রিয়াল। অর্থাৎ শিল্পোৎপাদনের চেয়ে ডলার আধিপত্য ও আর্থিক প্রভাবের ওপর তারা নির্ভরশীল। এর বিপরীতে চীন এখন ‘বিশ্বের কারখানা’। আন্তর্জাতিক সরবরাহব্যবস্থা, পণ্যপ্রবাহ এবং অবকাঠামো নেটওয়ার্কে চীনের অংশগ্রহণ গভীর ও বিস্তৃত।
সহজ করে বললে, আজকের যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে পুরো দুনিয়াকে প্রতিযোগিতার মঞ্চ বানিয়ে ফেলা আর সম্ভব নয়। এই প্রতিযোগিতা তার আর নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই।
লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত, চীন শুধু বিশ্বায়নের অংশগ্রহণকারী নয়, তারা এখন বিশ্বপ্রযুক্তি বদলের শর্তই নির্ধারণ করছে। কম খরচে উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে চীন বহু দেশের ডিজিটাল পরিকাঠামো গড়ে দিচ্ছে। হুয়াওয়ের ৫জি নেটওয়ার্ক, ক্লাউড পরিষেবা, ডিপসিকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিওয়াইডির বৈদ্যুতিক গাড়ি কিংবা চীনে তৈরি রোবট—সবকিছু মিলিয়ে চীন আজ এক নতুন ভৌগোলিক ও প্রাযুক্তিক রূপ গড়ে তুলছে। এর নাম দেওয়া যেতে পারে ‘জিও-টেকনোলজি’।
চীনের বিরুদ্ধে একটি বৈশ্বিক জোট গঠনের চিন্তা করার সময় মার্কিন জোটগুলো নিজেদের ভেতরকার অসংগতি বিবেচনায় রাখে না। পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, আরব উপসাগর কিংবা এমনকি আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যেও চীনের প্রতি মনোভাব একরকম নয়। অনেকে চীনের ভূমিকায় উদ্বিগ্ন। কিন্তু তারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো করে বৈশ্বিক সংঘাতে যেতে আগ্রহী নয়। কারণ, তাদের নিজেদের অর্থনীতি চীনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
একসময় যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিক সুবিধা দিয়ে রাজনৈতিক জোট গড়ে তুলত। সেই নীতি এখন আর কার্যকর নয়। মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখন নিজের ‘ঘরের শ্রমিক’ আর ‘জাতীয় স্বার্থ’ নিয়েই বেশি কথা হয়। ফলে আগের মতো কৌশলগত উদারতা দেখানো এখন আর রাজনৈতিকভাবে সম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বরং এখন নিজের দিকে ফিরে তাকানো দরকার। তার উচিত এই বৈশ্বিক পরিবর্তনের সময়টিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের শিল্প ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা পুনর্গঠন করা। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যেমন চীন-ভারত সংঘাত, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে আসিয়ানের দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধ কিংবা বেইজিংয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা নিয়ে আঞ্চলিক উদ্বেগ—এসবকে কাজে লাগিয়ে আমেরিকার নতুন কৌশল সাজানো দরকার।
লক্ষ্য হওয়া উচিত সরাসরি মিত্র তৈরি নয়, বরং এমন পরিবেশ গড়ে তোলা, যেখানে অন্য দেশগুলো নিজেরাই চীনের আধিপত্যকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো চীন আর আমেরিকার মধ্যকার এই প্রতিযোগিতা কোনো মতাদর্শের নয়। এটি প্রযুক্তি, শিল্প ও ভূরাজনীতির প্রতিযোগিতা। তাই এটিকে কোনো বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হতে দেওয়া উচিত নয়।
এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা জেতার উপায় সোভিয়েত ধাঁচের পতনের অপেক্ষা নয়। বরং দরকার যুক্তরাষ্ট্রের নিজের কৌশলগত শক্তি বজায় রাখা। নতুন করে শিল্পায়ন, সামাজিক সহনশীলতা ও একটি ন্যায্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
চীন নতুন সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। আর এখন ১৯৫৫ সাল নয়। এখন ২০২৫ সাল। আগামী দিনের ইতিহাস আগের পথেই হাঁটবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
মোহাম্মদ সোলাইমান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক, নিউজউইক থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ