যশোর সদর উপজেলার বড় মেঘলা গ্রামের খায়রুল সরদার (৭০) ও হাসিনা বেগম (৬০) দম্পতি গ্রামেই একটি চায়ের দোকান চালান। ভালো দিনের আশায় সহায়–সম্বল খুইয়ে দুই ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। তাঁদের বড় ছেলে জাফর সরদারকে (৩৫) দালালেরা টাকা নিয়ে সাইপ্রাস পাঠানোর কথা বলে রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিয়েছেন। জাফরকে আর দেখতে পারবেন কি না, এই অনিশ্চয়তায় এই বৃদ্ধ দম্পতি দিন কাটাচ্ছেন।
পরিবারটির দুর্ভাগ্য এখানেই শেষ হয়নি। জাফরের ছোট ভাই বজলুর রহমান সরদারকে (৩০) দালালেরা পাঠিয়েছেন মালয়েশিয়া। সে দেশে কর্মরত অবস্থায় কাগজে ত্রুটি পাওয়ায় পুলিশ তাঁকে আটক করেছে। দেড় মাস ধরে বজলুর মালয়েশিয়ার কারাগারে আছেন। দালালের প্রতারণায় দুই ছেলেই বিদেশে অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছেন, এ দেখে তাঁদের বৃদ্ধ মা–বাবা অথই সাগরে পড়েছেন। ছেলেদের ফিরিয়ে আনতে এখন প্রতিদিন একে-ওকে ধরছেন তাঁরা।
আজ সোমবার সকালে বড় মেঘলা গ্রামে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির ফটকে তালা ঝুলছে। প্রতিবেশীরা জানান, তাঁরা আত্মীয় বাড়িতে গেছেন। ওনাদের চায়ের দোকানে গিয়ে খোঁজ নেন।
বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কে গালফ পেট্রলপাম্পের পাশে খায়রুল ও হাসিনা দম্পতির চায়ের দোকান। ওই দোকানের সামান্য আয়ে তাঁদের সংসার চলে। চায়ের দোকানে দেখা গেল, দুই পুত্রবধূ ও তিন নাতি-নাতনিকে নিয়ে খায়রুল সরদার আত্মীয় বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘বাড়িতে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল যা ছিল, তা বিক্রি করে এত দিন সংসার চালিয়েছি। এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই বউমাদের বেয়াই বাড়িতে রেখে আসতে যাচ্ছি।’
খায়রুল সরদার ও হাসিনা বেগম দম্পতির দুই ছেলে জাফর সরদার (ডানে) ও বজলুর রহমান সরদার (বাঁয়ে)ছবি: সংগৃহীত
খায়রুল সরদার বলেন, ‘দুই মাসের মধ্যে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পড়েছি। দুই ছেলে দুই দেশে আটকা পড়েছে। মাসখানেক আগে আমার মা মারা গেল। এখন দুই ছেলের ছোট ছোট তিন সন্তানই আমার জীবন। চা বিক্রি করে সংসার আর চালাতে পারছি না। সুদে টাকা নিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গরু বিক্রি করে ভালো দিনের আশায় দালালের মাধ্যমে দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠালাম। কিন্তু দালালেরা আমার জীবন শেষ করে দিল। দুই ছেলে দুই দেশে আটকা পড়ল।’
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঢাকার ‘ড্রিম হোম ট্রাভেলস’ নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে গত বছরের ১৭ আগস্ট সাইপ্রাসের উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন জাফর সরদার। এ জন্য একটি এনজিওর কাছ থেকে চার লাখ টাকা ঋণ করেন। এ ছাড়া জাফর তাঁর মা ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করেন এবং মানুষের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করেন। এভাবে মোট আট লাখ টাকা তাঁরা দিয়েছেন ড্রিম হোম ট্রাভেলসকে।
এই রিক্রুটিং এজেন্সি জাফরকে সাইপ্রাস নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ভিসার জন্য সে দেশের দূতাবাসে কাগজপত্র জমা দিয়েছিল। কিন্তু দুই বছরেও কোনো ভিসা না পেয়ে তাঁকে রাশিয়ায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যায় সৌদি আরবে। সেখান থেকে দুই মাস পর দুবাই, লিবিয়া বা তুরস্ক হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাশিয়ায়। জাফরের সঙ্গে দালাল আরও ৯ বাংলাদেশিসহ মোট ১০ জনকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে আসেন আকরাম নামে নরসিংদীর এক যুবক। বাকি নয়জনকে জোর করে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য পাঠানো হয় ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে তাঁদের মধ্যে একজন নিহত এবং একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
দালালের মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে বিপদে দুই ভাই জাফর সরদার (বাঁয়ে) ও বজলুর রহমান সরদার (ডানে)ছবি: সংগৃহীত
জাফরের স্ত্রী খাদিজা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জোর করে আমার স্বামীকে রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে গেছে দালাল চক্র। যুদ্ধ ব্যারাকে রেখে ছোট ছোট করে আর্মি ছাঁটে চুল কেটে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ মেসেজে তিনি জানিয়েছেন, “যেকোনো মূল্যে আমাকে দেশে ফিরিয়ে নাও”।’
এদিকে দালালের খপ্পরে পড়ে রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো বাংলাদেশি নয়টি পরিবারের স্বজনেরা তাঁদের মুক্তির দাবিতে কয়েক দফা ঢাকায় মানববন্ধন করেছেন। তাঁরা একাধিকবার রুশ দূতাবাস ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেছেন। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছেন।
জাফরের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার টাকাসহ জাফর সরদারকে ফেরত চেয়ে তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন।
জাফরের মা হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে। আমার বুকের মানিক দুই ছেলে দুই দেশে আটকে আছে। মা হয়ে আমি কেমনে সহ্য করব...। আমাদের কারও এখন মাথা ঠিক নেই। দোকানটিও ঠিকমতো চালাতে পারছি না। কবে যে আমার মানিকেরা আমার বুকে ফিরবে!’
বজলুর রহমানের স্ত্রী তুহিনা খাতুন বলেন, ‘দুই বছর মালয়েশিয়ায় থেকে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার স্বামী বাড়িতে ফেরেন। এরপর দুই মাস আগে আবার মালয়েশিয়ায় যান। সে দেশে কর্মরত অবস্থায় পুলিশ একসঙ্গে শতাধিক মানুষকে আটক করে। যে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে তিনি যান, ওই এজেন্সির পক্ষ থেকে কেউ হাজির না হওয়ায় পাসপোর্টে লাল সিল মেরে দিয়েছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে জানতে পেরেছি।’
খায়রুল সরদার বলেন, ‘ছেলেগের ফিরে আসার আশায় আল্লাহর কাছে দোয়া করে দুটি মসজিদে মিলাদ দিছি। প্রতি শুক্রবার মসজিদি মসজিদি মিলাদ দিচ্ছি। আল্লাহ যদি ডাক শোনে। আর তো কোনো উপায় দেখতিছিনে।’