টিউলিপকে কি সম্পত্তি নিয়ে বিতর্কেই মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হলো
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 15-01-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

যুক্তরাজ্য সরকারের দুর্নীতির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যখন নিজ উদ্যোগে তদন্তের অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তখন টিউলিপ সিদ্দিক জানতেন, তদন্তে সম্পূর্ণ অব্যাহতি পেলেই যুক্তরাজ্যে তাঁর মন্ত্রিত্ব টিকে যাবে। গতকাল মঙ্গলবার স্যার লাউরি ম্যাগনাস (টিউলিপকে নিয়ে তদন্তের বিষয়ে মন্ত্রিত্বের মানদণ্ডবিষয়ক স্বাধীন উপদেষ্টা) এমন কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ব্যর্থ হয়েছেন।

তিনি (স্যার লাউরি ম্যাগনাস) উপসংহার টেনেছেন, যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টির সরকারের অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী (ইকোনমিক সেক্রেটারি) টিউলিপ সিদ্দিক, যিনি কিনা সরকারের দুর্নীতি দমনের দায়িত্বে নিয়োজিত; তাঁর বিরুদ্ধে মন্ত্রিত্বের মানদণ্ড লঙ্ঘন করার কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে টিউলিপ একেবারে নিষ্কলুষ—এ কথাও বলেননি তিনি।

 

২০১৩ সালে তোলা একটি আলোকচিত্র নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ওই আলোকচিত্রে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রয়েছেন। সঙ্গে আছেন টিউলিপও। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের শতকোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি সইয়ের সময় সেটি তোলা হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে প্রতিবেদন দিয়েছেন স্যার লাউরি ম্যাগনাস। ভোটারদের কাছে ‘নৈতিক সরকার’ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাস ছয়েক আগে ক্ষমতায় বসেছেন লেবার নেতা কিয়ার স্টারমার। তাই সরকার থেকে একজন সহকর্মীকে ছেঁটে ফেলা ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। তা–ও এটা এমন একজন ব্যক্তির (টিউলিপ) সঙ্গে ঘটেছে, যাঁকে কিনা প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবে মনে করা হয়—সরকারের জ্যেষ্ঠ এক সূত্র এমনটাই বলছিল।

পরিবার

টিউলিপ সিদ্দিক সাধারণ কোনো রাজনীতিবিদ নন। তাঁর খালা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। গত বছর শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়েছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সরকারি অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর কোটি কোটি পাউন্ড বিদেশে পাচার করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ডিসেম্বরে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে। ওই তদন্তে টিউলিপ সিদ্দিকের নামও এসেছে।

 

তবে একটি বিষয়ে স্যার লাউরি ম্যাগনাস নির্দ্বিধায় বলেছেন, বাংলাদেশের শাসনকাঠামোর সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ততা যে তাঁর ও লেবার সরকারের সুনামের জন্য ঝুঁকির হতে পারে, সে বিষয়ে টিউলিপ পর্যাপ্ত সতর্ক ছিলেন না।

স্যার লাউরি ম্যাগনাস বলেছেন, ‘পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার ঘটনা তাঁর নিজের ও সরকারের (যুক্তরাজ্য) সুনাম ঝুঁকিতে ফেলতে পারে—এ বিষয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের আরও সতর্ক না থাকাটা খুবই দুঃখজনক।’

প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে লেখা স্যার লাউরি ম্যাগনাসের চিঠির সবচেয়ে নিয়তিসূচক লাইন ছিল—‘এর আলোকে আপনি চাইলে তাঁর (টিউলিপ) চলমান দায়িত্ব বিবেচনা করতে পারেন।’

তবে চিঠিতে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে দুর্নীতি দমনবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা টিউলিপের বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তার সপক্ষে টেকসই কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সম্পত্তি

টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মূলে রয়েছে তিনি এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে একাধিক সম্পত্তি পেয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে তাঁর খালার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় টিউলিপ সিদ্দিককে একটি ফ্ল্যাট বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছিল। আরেকটি ফ্ল্যাট টিউলিপের বোন উপহার পেয়েছিলেন। হ্যাম্পস্টেড এলাকার ওই ফ্ল্যাটে একসময় টিউলিপ নিজেও বসবাস করতেন। পরে ফিঞ্চলে এলাকায় ২১ লাখ পাউন্ডের যেই বাড়িতে টিউলিপ থাকতেন, সেটাও তাঁর খালার (শেখ হাসিনা) সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বাংলাদেশি এক ব্যবসায়ীর মালিকানায় ছিল।

কিংস ক্রস এলাকায় অবস্থিত ফ্ল্যাট নিয়ে তদন্তে মনোযোগ দিয়েছিলেন স্যার লাউরি ম্যাগনাস। টিউলিপের দাবি, ওই ফ্ল্যাট তাঁর মা-বাবা তাঁকে দিয়েছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, একজন আবাসন ব্যবসায়ী এবং আওয়ামী লীগের কিছু ব্যক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে, এমন এক ব্যক্তি ওই ফ্ল্যাটের মূল্য পরিশোধ করেছিলেন।

রাশিয়া সফরের সময় ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে পরিবারের সদস্যসহ টিউলিপ সিদ্দিকের এ ছবি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে

রাশিয়া সফরের সময় ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে পরিবারের সদস্যসহ টিউলিপ সিদ্দিকের এ ছবি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছেফাইল ছবি: এপি

দুই শয়নকক্ষের ওই ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। ২০০১ সালে সেটি ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ডে কিনেছিলেন আবদুল মোতালিফ নামের এক ব্যক্তি। পরবর্তী সময়ে সেটি টিউলিপকে দেওয়া হয়।

টিউলিপ দাবি করেন, ওই সম্পত্তি তাঁর মা–বাবা তাঁকে দিয়েছিলেন। তবে মোতালিফের সঙ্গে লেনদেনের বিবরণ প্রকাশ পাওয়ায় মন্ত্রী হওয়ার পর পুরোনো নথি সংশোধন করতে বাধ্য হন তিনি।

স্যার লাউরি ম্যাগনাস বলছেন, সম্পত্তিটি হাতবদলের ২০ বছর পেরিয়ে যাওয়ায় এটা নিশ্চিত করা যায়নি যে ওই সময় এই প্রক্রিয়ায় সব আর্থিক ও করবিধি অনুসরণ করা হয়েছিল। এটাকে ‘দুঃখজনক’ বলেছেন স্যার লাউরি ম্যাগনাস। যদিও সঙ্গে যুক্ত করেছেন, ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।’

স্যার লাউরি ম্যাগনাস উল্লেখ করেছেন, ২০২২ সালে সংবাদমাধ্যম ‘দ্য মেইল অন সানডে’র পক্ষ থেকে টিউলিপকে কিংস ক্রসের ওই ফ্ল্যাটের মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। টিউলিপ জোর দিয়ে বলেছিলেন, সেটা তাঁর মা–বাবা তাঁকে দিয়েছেন।

ওই সময়ে উপহারের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ভূমি স্থানান্তর নিবন্ধন ফরমে সই করার পরও এমন দাবি করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন স্যার লাউরি ম্যাগনাস। তিনি বলেন, এটা টিউলিপের পক্ষ থেকে দুঃখজনক ভুল–বোঝাবুঝি। মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি মালিকানার উৎস সম্পর্কে ওই সরকারি নথি সংশোধন করিয়েছেন।

 

রাশিয়া সফর

২০১৩ সালে তোলা একটি আলোকচিত্র নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ওই আলোকচিত্রে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রয়েছেন। মা শেখ রেহানার সঙ্গে আছেন টিউলিপও। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের শতকোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি সইয়ের সময় সেটি তোলা হয়েছিল।

রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তির মধ্যস্থতায় টিউলিপ সিদ্দিক সহায়তা করেছিলেন কি না, সেটা তদন্ত করে দেখছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। এই চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে টিউলিপের পরিবারের সদস্যদের প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের সম্ভাব্যতাও তদন্ত করা হচ্ছে।

রাশিয়ার সঙ্গে চড়া দামে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তির মধ্যস্থতায় টিউলিপ সিদ্দিক সহায়তা করেছিলেন কি না, সেটা তদন্ত করে দেখছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। এ চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে টিউলিপের পরিবারের সদস্যদের প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের সম্ভাব্যতাও তদন্ত করা হচ্ছে।

যদিও টিউলিপ তদন্তকারী স্যার লাউরি ম্যাগনাসকে বলেছেন, তাঁর ওই (রাশিয়া) সফরের উদ্দেশ্য ছিল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগ দেওয়া আর শহরটির (মস্কো) পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে ভ্রমণের মাধ্যমে উপভোগ করা।

টিউলিপ জোর দিয়ে বলেছেন, ওই সফরে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে আন্তসরকারি কোনো আলোচনায় তিনি যোগ দেননি। এ বিষয়ে স্যার লাউরি ম্যাগনাসের যুক্তি, তিনি টিউলিপের যুক্তি মেনে নিয়েছেন। এটাকে ‘ফেস ভ্যালু’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁর মতে, বিষয়টি বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের তদন্তের অংশ হতে পারে।

 

আরও তদন্ত

টিউলিপের সঙ্গে তাঁর খালার সম্পর্কের বিষয়ে তদন্ত করে দেখছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দাবি করা হয়েছে যে শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীরা দেশ থেকে কোটি কোটি পাউন্ড আত্মসাৎ করেছেন। আর এর মধ্য থেকে কিছু অর্থ বিদেশে সম্পত্তি কেনার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের জাতীয় অপরাধ-সংক্রান্ত সংস্থার আন্তর্জাতিক দুর্নীতি ইউনিট বাংলাদেশের দুদককে দেশ থেকে পাচার করা অর্থ দিয়ে যুক্তরাজ্যের মাটিতে কেনা সম্পত্তি শনাক্ত করতে সহায়তা করছে।

কিয়ার স্টারমার ও তাঁর সরকারের সামনে বিপদ ছিল, এসব তদন্ত শেষ হতে সম্ভবত অনেক মাস লেগে যেতে পারে। সেই সঙ্গে তদন্তের স্বার্থে টিউলিপকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।

 

ম্যাগনাসের উপসংহার

তদন্তে স্যার লাউরি ম্যাগনাস মূলত যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীদের জন্য বেধে দেওয়া নিয়মশৃঙ্খলার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি যাচাই করার চেষ্টা করেছেন, টিউলিপ আদতে মন্ত্রিত্বের মানদণ্ড লঙ্ঘন করেছেন কি না। কিংবা টিউলিপের কোনো কাজ এই মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না।

স্যার লাউরি ম্যাগনাস এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় খুঁজে পাননি। তবে প্রকৃতিগতভাবে এই তদন্ত ছিল সীমিত। মাত্র আট দিনে তদন্ত শেষ করতে হওয়ায় তিনি টিউলিপের সম্পত্তির কর ব্যবস্থাপনা এবং তহবিলের উৎস নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পাননি।

এসব তথ্য-উপাত্ত না পাওয়াকে ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন স্যার লাউরি ম্যাগনাস। তিনি মস্কো সফর ও পুতিনের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে টিউলিপের যুক্তি নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে নিয়েছেন পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ না থাকায়। তবে তিনি সুযোগ অবারিত রেখেছেন যে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের তদন্তে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত প্রমাণ বেরিয়ে আসতে পারে।

তবে একটি বিষয়ে স্যার লাউরি ম্যাগনাস নির্দ্বিধায় বলেছেন, বাংলাদেশের শাসনকাঠামোয় জড়িত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যে তাঁর ও লেবার সরকারের সুনামের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে, সে বিষয়ে টিউলিপ পর্যাপ্ত সতর্ক ছিলেন না।

প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের উদ্দেশে তাঁর (স্যার লাউরি ম্যাগনাস) চূড়ান্ত পারমর্শ—প্রধানমন্ত্রীর সামনে আর বিকল্প নেই।

স্যার লাউরি ম্যাগনাস লিখেছেন, ‘আমি এটা বলব না যে এই বিচ্যুতি মন্ত্রিত্বের মানদণ্ড লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা উচিত হবে। তবে আপনি চাইলে এর আলোকে তাঁর (টিউলিপ) চলমান দায়িত্বগুলো বিবেচনা করতে পারেন।’

শেয়ার করুন