ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দশম, একাদশ ও সর্বশেষ দ্বাদশ (২০২৪ সাল) জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের বিদেশি নাগরিকত্বের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ১৮৮টি দেশে বাংলাদেশ দূতাবাস/মিশনে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। সাবেক এসব সংসদ সদস্যের কারও বিদেশি নাগরিকত্ব বা রেসিডেন্স কার্ড থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য ছিলেন, এমন ২৪ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব (কারও কারও ক্ষেত্রে রেসিডেন্স কার্ড বা গ্রিন কার্ড) থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে দুদক।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলে তিনি সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হতে পারবেন না। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য ছিলেন, এমন বেশ কয়েকজনের দ্বৈত নাগরিকত্ব (কারও কারও ক্ষেত্রে রেসিডেন্স কার্ড বা গ্রিন কার্ড) থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রসঙ্গত, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেতে চাইলে কোনো ব্যক্তিকে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কোনো কোনো রাষ্ট্রে রেসিডেন্স কার্ড বা গ্রিন কার্ড পাওয়ার পরের ধাপে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, এমন কোনো ব্যক্তির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া বা মন্ত্রিত্ব লাভের সুযোগ নেই। তথ্য গোপন করে যদি এ কাজ হয়ে থাকে, তবে আইন ও সংবিধানপরিপন্থী কাজ হয়েছে।
জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী
দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়া এমন ব্যক্তির সংখ্যা কত, তা জানতে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
চিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণকারী বাংলাদেশিদের বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে পাসপোর্ট নবায়ন করতে হয়। এ ছাড়া নো ভিসা রিকোয়ার্ডসহ (এনভিআর) অন্যান্য কনস্যুলার সেবা নিয়ে থাকেন তাঁরা। এমন বাংলাদেশিদের বিষয়ে মিশন/দূতাবাস তথ্য দিতে পারে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বিদেশি নাগরিকত্বের তথ্য গোপন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও পরে মন্ত্রী-এমপির পদ লাভ করা ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে বিদেশে বাংলাদেশ মিশন/দূতাবাসের সহযোগিতা প্রয়োজন।
একটি সূত্র বলছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো বিদেশি মিশন/দূতাবাসে চিঠি পাঠানো শুরু করেনি।
চিঠিতে গত ৫ নভেম্বর প্রথম আলোতে ‘বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে মন্ত্রী-এমপি হন ২৪ জন’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কপি যুক্ত করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গোপনে সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের ‘রেসিডেন্স কার্ড’ (স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি) রয়েছে বেলজিয়ামের। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যুক্তরাজ্যের নাগরিক। সাবেক দুই প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও জুনাইদ আহমেদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকার বৈধ অনুমতি বা ‘গ্রিন কার্ড’ রয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য ছিলেন, এমন ২৪ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব (কারও কারও ক্ষেত্রে রেসিডেন্স কার্ড বা গ্রিন কার্ড) থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে দুদক।
দুদকের তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক পাঁচ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নাগরিকত্ব রয়েছে যুক্তরাজ্যে। তাঁরা হলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল, মো. তাজুল ইসলাম, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও মো. মাহবুব আলী। তাঁদের মধ্যে গত ১৫ সেপ্টেম্বর মাহবুব আলীকে গ্রেপ্তার করার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে, এমন কোনো ব্যক্তির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া বা মন্ত্রিত্ব লাভের সুযোগ নেই। তথ্য গোপন করে যদি এ কাজ হয়ে থাকে, তবে আইন ও সংবিধানপরিপন্থী কাজ হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বিদেশি নাগরিকত্ব নিতেই পারেন। বিদেশি নাগরিকত্ব নিলেও তাঁর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বহাল থাকে। বাংলাদেশ নাগরিকত্ব (অস্থায়ী বিধানাবলি) আদেশ ১৯৭২–এর আলোকে দেশের কোনো নাগরিক বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও সে দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার সময় শপথ বাক্যে যদি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহারের শপথ না থাকে, তবে তাঁর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বহাল থাকে। তখন দ্বৈত নাগরিকত্ব সনদ নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে সরকারি চাকরি, সংসদ সদস্য হতে গেলে তাঁর বিদেশি নাগরিকত্ব থাকা চলবে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, তাঁদের মূল লক্ষ্য বিদেশি নাগরিকত্বের তথ্য গোপন করে কতজন সংসদ সদস্য ও পরে মন্ত্রী হয়েছেন, তা আগে জানা। পরবর্তী সময়ে তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া।