যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত বছর বাংলাদেশে যত পণ্য আমদানি হয়েছে, তার গড় শুল্কহার ছিল ৬ শতাংশ। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০০ টাকার পণ্য আমদানিতে সরকার গড়ে শুল্ক–কর আদায় করেছে ৬ টাকা ১৫ পয়সা। অবশ্য আমদানি পর্যায়ে আদায় হওয়া মূল্য সংযোজন কর, অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম কর—এই তিনটি পরে সমন্বয় করে নেন ব্যবসায়ীরা। সমন্বয় করা হয় এমন তিনটি কর বাদ দিলে কার্যত গড় শুল্কহার দাঁড়ায় ২ দশমিক ২০ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে দেশভেদে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এরপর সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের শুল্ক–কর কমানোর পর্যালোচনার ঘোষণা দেয়। এতে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে গড় শুল্ক–কর কত, কোন পণ্যে কত শুল্কহার—এমন বিষয়গুলো আবারও সামনে এসেছে।
পাল্টা শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে ট্রাম্প বাণিজ্য–ঘাটতি ও যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির হিসাব বিবেচনায় নিয়েছেন। ট্রাম্পের সূত্র অনুযায়ী, পাল্টা শুল্ক কমাতে হলে বাণিজ্য–ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। বাণিজ্য–ঘাটতি কমিয়ে আনতে হলে সহজপথ হলো মার্কিন পণ্যে শুল্কছাড়। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নিয়ে কী করা যায়, তা নিয়ে এনবিআর ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন কাজ শুরু করেছে।
জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের শুল্ক-কর কমানোর বিষয়ে এনবিআরের পক্ষ থেকে কী করা যেতে পারে, তা চিন্তা করা হচ্ছে। আগামীকাল রোববার এ নিয়ে এনবিআরে বৈঠক হবে।
প্রথম আলোর হাতে থাকা এনবিআরের তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত বছর বাংলাদেশ ২৯১ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য ছিল ৩৫ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। এসব পণ্য থেকে মোট শুল্ক–কর আদায় হয়েছে ২ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা, অর্থাৎ গড়ে শুল্ক–কর আদায় হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে মূলত দুই শ্রেণিতে পণ্য আমদানি হয়। একটি হলো বন্ডের আওতায় আনা রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল। আরেকটি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য আমদানি করা পণ্য। গত বছর রপ্তানি কাঁচামাল আমদানি হয়েছে প্রায় ২৯ কোটি ডলারের, যেগুলোর জন্য শুল্ক–কর দিতে হয়নি। আবার অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য আমদানি করা ২৬১ কোটি ডলার পণ্যের মধ্যে শুল্ক–কর দিতে হয়নি এমন পণ্যের আমদানি ছিল ৭৯ কোটি ডলারের।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ হাজার ৫১৫টি এইচএসকোডের (পণ্যের শ্রেণি বিভাজন) পণ্য আমদানি হয়েছে বাংলাদেশে। আমদানি হওয়া পণ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ শুল্ক–করের হার ছিল ৬১১ শতাংশ। সর্বনিম্ন হার ছিল শূন্য শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া সর্বোচ্চ শুল্ক–কর আছে এমন পণ্যের মধ্যে রয়েছে হুইস্কি। হুইস্কিতে শুল্ক–কর ৬১১ শতাংশ। তবে আমদানি খুবই কম। গত বছর ২২৮ বোতল জ্যাক ডেনিয়েল হুইস্কি আমদানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর বিপরীতে শুল্ক–কর আদায় হয়েছে ৩১ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শুল্ক–করযুক্ত পণ্য হলো মার্সিডিজ বেঞ্জ। এ গাড়িতে শুল্ক–কর ৪৪৩ শতাংশ। গত বছর আমদানি হয়েছে চারটি মার্সিডিজ বেঞ্জ। এর বিপরীতে শুল্ক–কর আদায় হয়েছে ১৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ শুল্ক–করযুক্ত পণ্যের মধ্যে রয়েছে ভ্যাপ ও ই–সিগারেটে। এসব পণ্যে শুল্ক–কর ২৮৯ শতাংশ। গত বছর মাত্র ৭৩ হাজার ডলারের ভ্যাপ ও ই–সিগারেট আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে শুল্ক–কর আদায় হয়েছে তিন কোটি টাকা।
চতুর্থ সর্বোচ্চ শুল্ক–করযুক্ত পণ্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ও গাড়ি (১৬০০ থেকে ২০০০ হাজার সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি)। এ ধরনের পণ্য আমদানি থেকে শুল্ক–কর আদায় হয়েছে ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয় পুরোনো লোহার টুকরা থেকে। রড তৈরির কাঁচামাল হিসেবে এসব লোহার টুকরা আমদানি করা হয়। প্রতি মেট্রিক টনে নির্ধারিত শুল্ক আদায় হয়। তাতে শুল্কহার ৪ শতাংশ পড়ে। গত বছর ৪৫০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে এই খাত থেকে।
শুল্ক–করের হার সব দেশেই প্রায় একই। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আওতায় (যেমন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা সাফটা) নির্ধারিত পণ্যে শুল্ক সুবিধা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সরকার কোন পণ্যে শুল্কহার পর্যালোচনা করবে, তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। শুল্ক–কর কমাতে হলে গাড়ির মতো বিলাসপণ্য বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, বিলাসপণ্যে সবচেয়ে বেশি শুল্ক–কর রয়েছে।
দূরত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে খরচ বেশি। এ কারণে কম দূরত্বের দেশ ভারত ও চীন থেকে পণ্য আমদানি বেশি হয়। এরপরও পণ্যের মান ও সহজলভ্যতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক পণ্য আমদানি করা হয়।