নারী ফুটবলারদের পাশে দাঁড়ান; তাঁরা শুধু নিজেরা জেতেন না, জেতান দেশকে
সিএইচটি টিভি ডেস্ক
  • প্রকাশিত : 02-02-2025
ফাইল ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের মেয়েরা আমাদের দু–দুবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট এনে দিয়েছেন। বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে তাঁদের সাফল্যের পাল্লা আরও অনেক ভারী। গত বছর নেপালের কাঠমান্ডুর রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে নেপালের বিরুদ্ধে ঋতুপর্ণা চাকমার গোলটা চোখে লেগে আছে। ২-১ গোলে বাংলাদেশ জিতেছিল সেই ম্যাচটা।

পরপর দুবার সাফ চ্যাম্পিয়নের গৌরব আমাদের এনে দিয়েছেন নারী ফুটবলাররা। বাংলাদেশই বর্তমান সাফ চ্যাম্পিয়ন। ২০২৪ সালের অক্টোবরে দেশে ফেরেন চ্যাম্পিয়নরা, হুডখোলা বাসে করে তাঁদের নিয়ে আসা হয় বিমানবন্দর থেকে। সমস্ত দেশ আনন্দে ভাসতে থাকে।

 

এবার অপমানে কাঁদলেন সাবিনা-মাসুরারা

 

 

এই ঋতুপর্ণা ক্যামেরার সামনে প্রথম আলোর স্টুডিওতে আমাকে বলেছেন, ‘আমার পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে কথা বলতে একেবারেই সংকোচ নেই। আমার বাবা মারা গেছেন। একমাত্র ভাই মারা গেছে দুর্ঘটনায়। এক বোন নিয়ে আমার নিঃসঙ্গ মা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।’

আপনারা অনেকেই ঋতুপর্ণা চাকমার মায়ের ছবি দেখেছিলেন। এক পর্ণকুটিরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণার মা। পরে তাঁদের একটা বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অভাব কি গেছে ওই পরিবারের?

বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচ পিটার বাটলার (বাঁয়ে) ও অধিনায়ক সাবিনা খাতুন

বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচ পিটার বাটলার (বাঁয়ে) ও অধিনায়ক সাবিনা খাতুনছবি: বাফুফে

আপনারা জানেন, তবুও বারবার করে মনে করিয়ে দিতে চাই: এই মেয়েরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ত, তখন তারা ফুটবল খেলতে স্কুলমাঠে আসত। কারণ, ফুটবল খেললে দুটো বিস্কুট খেতে পাওয়া যায়, কখনো কখনো হয়তো সঙ্গে কলা থাকে। এদের অনেকেই শুধু একটুখানি খাবার পাওয়ার আশায় মাঠে আসত।

 

মায়ের সঙ্গে সাফজয়ী ঋতুপর্ণা চাকমা

মায়ের সঙ্গে সাফজয়ী ঋতুপর্ণা চাকমাছবি: সংগৃহীত

কতবার বলব, আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগের কথা। ২০১৫ সালে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রামের ফুটবলার মেয়েদের ওপরে প্রথম আলো একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে। আজকের সানজিদা, মারিয়া, শামসুন নাহাররা তখন অনেক ছোট। অনূর্ধ্ব–১৪। ওরা সারা দিন শুটিং করে। ওদের এই পরিশ্রম দেখে প্রথম আলোর প্রতিনিধি ওদের বলেন, ‘তোমরা অনেক কষ্ট করলে। আমাদের কাছে কিছু চাও।’ ওরা জবাব দেয়, ‘আমাদের এক বেলা পেট ভরে ভাত খাওয়ান।’ উত্তরে আমরা বলি, ‘তোমরা আরও বেশি কিছু চাও।’ মেয়েরা এবার বলে, ‘তাহলে আমাদের পেট ভরে ভাত খাওয়ান; আর আরও কিছু খাবার আমাদের দিয়ে দেন। আমরা বাড়িতে নিয়ে যাব। আমাদের ভাইবোনেরা খাবে।’

আমি তো কলসিন্দুর গ্রামে দুবার গেছি। এখনো ওখানকার শিশু-কিশোরীরা ফুটবল খেলে। ওই শিশুদের চোখ-মুখের দিকে তাকালেই আমি দেখতে পাই অপুষ্টির চিহ্ন। কিশোর আলোর উদ্যোগে ওই গ্রামের ৩৩ জন ফুটবলার ও ১ জন কোচকে প্রতি মাসে সামান্য বৃত্তি পাঠিয়ে দিই। ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। কোনো মাসে ওই টাকা যেতে দেরি হলে ওরা ফোন করে, স্যার, এই মাসের টাকাটা তো পাইলাম না। আমার চোখ ভিজে আসে। মাত্র ৫০০ টাকাও ওদের জন্য অনেক টাকা।

 

কোচ বাটলারের বিরুদ্ধে নারী ফুটবলারদের যত অভিযোগ

কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হকের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে খুনসুটিতে মেতেছেন মারিয়া মান্দা ও সানজিদা আক্তার। ২০২২ সালে ময়মনসিংহের মন্দিরগোনা থেকে কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে

কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হকের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে খুনসুটিতে মেতেছেন মারিয়া মান্দা ও সানজিদা আক্তার। ২০২২ সালে ময়মনসিংহের মন্দিরগোনা থেকে কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথেছবি: খালেদ সরকার

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে ধন্যবাদ। তারা আজ থেকে বেশ কয় বছর আগেই কিশোরী ফুটবলারদের ঢাকার ক্যাম্পে সারা বছর রেখে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। তার সুফল আমরা পাচ্ছি। পরপর দুবার বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়নের গৌরব এনে দিয়েছে মেয়েরা।

কিন্তু প্রিয় পাঠক, আপনারা কি একবার এই মেয়েদের চোখ দিয়ে সমস্ত বিষয়টা একবার ভাববেন! সাতক্ষীরা থেকে, টাঙ্গাইল থেকে, রংপুর থেকে, রাঙামাটি থেকে ১২–১৩ বছরের মেয়েরা ঢাকায় এসে থাকছে হোস্টেলে, তাদের মা–বাবা, পরিবার ছেড়ে। কঠিন শৃঙ্খলাবদ্ধ কঠোর পরিশ্রমে ভরা তাদের একটা দিন। অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়, তারপর চলে যেতে হয় মাঠে। অনুশীলন, অনুশীলন। শ্রান্ত হয়ে ফেরে তারা।

 

অশ্রু মুছে অভিনন্দন চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের

পেট ভরে খেতে পারে না। হয়তো এটা তাদের ডায়েট চার্টের কারণে, হয়তো ফুটবল ফেডারেশনের বাজেট বরাদ্দ না থাকায়। বিকেলে আবার মাঠে যাও। এই মেয়েগুলো আমাদের চোখের সামনে বড় হচ্ছে বলে আমি তাদের আমার নিজের মেয়ের মতো করে দেখি। আমার সঙ্গে যখনই দেখা হয়, প্রথম কথা ওদের, ‘খেতে দেন।’ এক বেলা ভাত, এক বেলা রুটি খেয়ে প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রম করা মেয়েগুলো এখনো একটু শান্তিমতো ভাত খেতে চায়।

২০২২ সাল পর্যন্ত মেয়েরা কত টাকা করে মাসিক ভাতা পেত জানেন? ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। ২০২২ সালে ওরা যখন সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়, তারপর তারা বেতন বাড়ানোর জন্য আবেদন-নিবেদন করতে থাকে। এখন সাবিনা, মারিয়াদের মতো সিনিয়রদের বেতন ৫০ হাজার করা হয়েছে। ছোটদের বেতন এখনো ১০ হাজারই রয়ে গেছে। ভাবছেন, ভালোই তো। কিন্তু এই বেতনও অনিয়মিত। অক্টোবরের পর থেকে তারা আর বেতন পায়নি। বাফুফের সভাপতি ঘোষণা দিয়েছেন, চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের দেড় কোটি টাকা দেওয়া হবে, এটা মেয়েরা এখনো পায়নি। খেলার জন্য মেয়েদের ৫ হাজার, ১০ হাজার টাকা করে ম্যাচ ফি পাওয়ার কথা ছিল, তা–ও তাদের দেওয়া হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনের পর বাফুফে চত্বরে ফুটবলাররা

সংবাদ সম্মেলনের পর বাফুফে চত্বরে ফুটবলাররা

 

এই মেয়েরা এই বিরূপ সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ফুটবল খেলে। তাদের লড়াই তো শুধু নেপাল বা ভারতের বিরুদ্ধে নয়, সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে নারী ফুৃটবলাররা কাঁদছিলেন দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে আক্রমণ আর কটাক্ষের কথা মনে করে।

আপনি চিন্তা করুন, ১২ বছরের এক গ্রামীণ বালিকা এসেছে শহরে, হোস্টেলে থাকে, সারা দিন কঠোর প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনে কাটে তাদের দিন, পেট ভরে খায় না এবং মা–বাবা, ভাই–বোন থেকে থাকে বহুদূরে। আজকে ইনজুরি কিংবা বয়সের কারণে যখন সে খেলার বাইরে চলে যাবে, সে করবেটা কী?

জাতীয় দলের চ্যাম্পিয়ন ফুটবলারদের নাহয় আমরা চিনি। তাদের সাফল্য আর ব্যর্থতার কাহিনি আমরা লিখে রাখতেও পারব। কিন্তু সারা দেশে যে শত শত মেয়ে ফুটবল খেলে, তাদের জীবনের কাহিনি কঠিন সংগ্রামের। হয়তো কোনো একটা ম্যাচে খেলতে কেউ নিয়ে গেল আরেক জেলায়, হাতে ধরিয়ে দিল ৫০০ টাকা। যারা জাতীয় দলে ডাক পায় না, বাফুফের ক্যাম্পে আসতে পারে না, তাদের দীর্ঘশ্বাস কোথাও পৌঁছায় না।

শেয়ার করুন